ছিয়ামের ফাযায়েলঃ
(ক) রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন, ‘যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে ছওয়াবের আশায় রামাযানের ছিয়াম পালন করে, তার বিগত সকল গুনাহ মাফ করে দেওয়া হয়’।
(খ) রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আরও বলেন, ‘আদম সন্তানের প্রত্যেক নেক আমলের ছওয়াব দশগুণ হ’তে সাতশত গুণ প্রদান করা হয়। আল্লাহ বলেন, কিন্তু ছওম ব্যতীত, কেননা ছওম কেবল আমার জন্যই (রাখা হয়) এবং আমিই তার পুরস্কার প্রদান করব। সে তার যৌনাকাঙ্খা ও পানাহার কেবল আমার জন্যই পরিত্যাগ করে। ছিয়াম পালনকারীর জন্য দু’টি আনন্দের মুহূর্ত রয়েছে। একটি ইফতারকালে, অন্যটি তার প্রভুর সাথে দীদারকালে। তার মুখের গন্ধ আল্লাহর নিকটে মিশকে আম্বরের খোশবুর চেয়েও সুগন্ধিময়। ছিয়াম (অন্যায় অপকর্মের বিরুদ্ধে) ঢাল স্বরূপ। অতএব যখন তোমরা ছিয়াম পালন করবে, তখন মন্দ কথা বলবে না ও বাজে বকবে না। যদি কেউ গালি দেয় বা লড়াই করতে আসে তখন বলবে, আমি ছায়েম’।
মাসায়েলঃ
১. ছিয়ামের নিয়তঃ নিয়ত অর্থ- মনন করা বা সংকল্প করা। অতএব মনে মনে ছিয়ামের সংকল্প করাই যথেষ্ট। হজ্জের তালবিয়া ব্যতীত ছালাত, ছিয়াম বা অন্য কোন ইবাদতের শুরুতে আরবী বা অন্য ভাষায় নিয়ত পড়া বিদ‘আত।
২. সাহারী ও ইফতারঃ রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, (ক) ‘তোমরা সাহারী কর। কেননা সাহারীতে বরকত রয়েছে’। তিনি বলেন, (খ) ‘আহলে কিতাবদের সাথে আমাদের ছিয়ামের পার্থক্য হ’ল সাহারী খাওয়া’। তিনি আরও বলেন, (গ) ‘সাহারীর সময় খাদ্য বা পানির পাত্র হাতে থাকা অবস্থায় তোমাদের কেউ ফজরের আযান শুনলে সে যেন প্রয়োজন পূরণ করা ব্যতীত পাত্র রেখে না দেয়’। তিনি বলেন, (ঘ) ‘তোমরা ইফতার দ্রুত কর এবং সাহারী দেরীতে কর’।
৩. ইফতারকালে দো‘আঃ ‘বিসমিল্লাহ’ বলে শুরু ও ‘আলহামদুলিল্লাহ’ বলে শেষ করবে। ইফতারের দো‘আ হিসাবে প্রসিদ্ধ আল্লাহুম্মা লাকা ছুমতু… হাদীছটি ‘যঈফ’। ইফতার শেষে নিম্নোক্ত দো‘আ পড়া যাবে- ‘যাহাবায যামাউ ওয়াবতাল্লাতিল উরূকু ওয়া ছাবাতাল আজরু ইনশাআল্লাহ’ (‘পিপাসা দূরীভূত হ’ল ও শিরাগুলি সঞ্জীবিত হ’ল এবং আল্লাহ চাহেন তো পুরস্কার ওয়াজিব হ’ল’)। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, দ্বীন চিরদিন বিজয়ী থাকবে, যতদিন লোকেরা ইফতার তাড়াতাড়ি করবে। কেননা ইহূদী-নাছারারা ইফতার দেরীতে করে’।
৪. সাহারীর আযানঃ রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর যামানায় তাহাজ্জুদ ও সাহারীর আযান বেলাল (রাঃ) দিতেন এবং ফজরের আযান অন্ধ ছাহাবী আব্দুল্লাহ ইবনু উম্মে মাকতূম (রাঃ) দিতেন। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ‘বেলাল রাত্রে আযান দিলে তোমরা খানাপিনা কর, যতক্ষণ না ইবনু উম্মে মাকতূম ফজরের আযান দেয়’। বুখারীর ভাষ্যকার হাফেয ইবনু হাজার আসক্বালানী (রহঃ) বলেন, ‘বর্তমান কালে সাহারীর সময় লোক জাগানোর নামে আযান ব্যতীত যা কিছু করা হয় সবই বিদ‘আত’। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন, ‘খাদ্য বা পানির পাত্র হাতে থাকাবস্থায় তোমাদের মধ্যে যদি কেউ ফজরের আযান শোনে, তবে সে যেন প্রয়োজন পূরণ না করে পাত্র রেখে না দেয়’।
৫. তারাবীহর ছালাতের ফযীলতঃ রাসূল (ছাঃ) বলেন, ‘যে ব্যক্তি রামাযানের রাত্রিতে ঈমানের সাথে ও ছওয়াবের আশায় রাত্রির ছালাত আদায় করে, তার বিগত সকল গোনাহ মাফ করা হয়’।
৬. তারাবীহর রাক‘আত সংখ্যাঃ
(১) হযরত আয়েশা (রাঃ) বলেন, ‘রামাযান বা রামাযানের বাইরে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) রাতের নফল ছালাত এগার রাক‘আতের বেশী আদায় করতেন না। তিনি প্রথমে (২+২) চার রাক‘আত পড়েন। তুমি তার সৌন্দর্য ও দীর্ঘতা সম্পর্কে জিজ্ঞেস কর না। অতঃপর তিনি (২+২) চার রাক‘আত পড়েন। তুমি তার সৌন্দর্য ও দীর্ঘতা সম্পর্কে জিজ্ঞেস কর না। অতঃপর তিন রাক‘আত পড়েন। ‘রাত্রির ছালাত’ বলতে তারাবীহ ও তাহাজ্জুদ দু’টোকেই বুঝানো হয় (মির‘আত)।
(২) হযরত ওমর (রাঃ) ১১ রাক‘আত তারাবীহ জামা‘আতের সাথে আদায় করার সুন্নাত পুনরায় চালু করেন, ২০ রাক‘আত নয়। যেমন হযরত সায়েব বিন ইয়াযীদ (রাঃ) বলেন, ‘খলীফা ওমর ইবনুল খাত্ত্বাব (রাঃ) হযরত উবাই বিন কা‘ব ও তামীম দারী (রাঃ)-কে রামাযানের রাত্রিতে ১১ রাক‘আত ছালাত জামা‘আত সহকারে আদায়ের নির্দেশ প্রদান করেন..’। তবে উক্ত বর্ণনার শেষদিকে ইয়াযীদ বিন রূমান প্রমুখাৎ ওমর (রাঃ)-এর যামানায় লোকেরা ২৩ রাক‘আত তারাবীহ পড়তেন’ বলে যে বাড়তি অংশ বলা হয়ে থাকে, সেটি যঈফ।
(৩) জাবের বিন আব্দুল্লাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) রামাযান মাসে আমাদেরকে ৮ রাক‘আত তারাবীহ ও বিতর ছালাত পড়ান। তিনি প্রতি দু’রাক‘আত অন্তর সালাম ফিরিয়ে আট রাক‘আত তারাবীহ শেষে কখনও এক, কখনও তিন, কখনও পাঁচ রাক‘আত বিতর এক সালামে পড়তেন। কিন্তু মাঝে বসতেন না।
দারুল উলূম দেউবন্দ-এর সাবেক মুহতামিম আল্লামা আনোয়ার শাহ কাশ্মীরী বলেন, একথা না মেনে উপায় নেই যে, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর তারাবীহ ৮ রাক‘আত ছিল।
৭. ছিয়াম ভঙ্গের কারণ সমূহঃ
(ক) ছিয়াম অবস্থায় ইচ্ছাকৃতভাবে খানাপিনা করলে ছিয়াম ভঙ্গ হয় এবং তার ক্বাযা আদায় করতে হয়।
(খ) যৌনসম্ভোগ করলে ছিয়াম ভঙ্গ হয় এবং তার কাফফারা স্বরূপ একটানা দু’মাস ছিয়াম পালন অথবা ৬০ (ষাট) জন মিসকীন খাওয়াতে হয়।
(গ) ছিয়াম অবস্থায় ইচ্ছাকৃতভাবে বমি করলে ক্বাযা আদায় করতে হবে। তবে অনিচ্ছাকৃত বমি হ’লে, ভুলক্রমে কিছু খেলে বা পান করলে, স্বপ্নদোষ বা সহবাসজনিত নাপাকী অবস্থায় সকাল হয়ে গেলে, চোখে সুর্মা লাগালে বা মিসওয়াক করলে ছিয়াম ভঙ্গ হয় না।
(ঘ) অতি বৃদ্ধ যারা ছিয়াম পালনে অক্ষম, তারা ছিয়ামের ফিদইয়া হিসাবে দৈনিক একজন করে মিসকীন খাওয়াবেন (বাক্বারাহ ২/১৮৪)। ছাহাবী আনাস (রাঃ) গোশত-রুটি বানিয়ে একদিনে ৩০ (ত্রিশ) জন মিসকীন খাইয়েছিলেন। ইবনু আববাস (রাঃ) গর্ভবতী ও দুগ্ধদানকারিণী মহিলাদেরকে ছিয়ামের ফিদইয়া আদায় করতে বলতেন।
(ঙ) মৃত ব্যক্তির ছিয়ামের ক্বাযা তার উত্তরাধিকারীগণ আদায় করবেন অথবা তার বিনিময়ে ফিদইয়া দিবেন। ফিদইয়ার পরিমাণ দৈনিক এক মুদ বা সিকি ছা‘ চাউল অথবা গম। তবে বেশী দিলে বেশী নেকী পাবেন (বাক্বারাহ ২/১৮৪)।
৮. ই‘তিকাফঃ ই‘তিকাফ তাক্বওয়া অর্জনের একটি বড় মাধ্যম। এতে লায়লাতুল ক্বদর অনুসন্ধানের সুযোগ হয়। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মসজিদে নববীতে রামাযানের শেষ দশকে নিয়মিত ই‘তিকাফ করেছেন। তাঁর মৃত্যুর পরে তাঁর স্ত্রীগণও ই‘তিকাফ করেছেন’। নারীদের জন্য বাড়ীর নিকটস্থ জুম‘আ মসজিদে ই‘তিকাফ করা উত্তম।
২০শে রামাযান সূর্যাস্তের পূর্বে ই‘তিকাফ স্থলে প্রবেশ করবে এবং ঈদের আগের দিন বাদ মাগরিব বের হবে। তবে বাধ্যগত কারণে শেষ দশদিনের সময়ে আগপিছ করা যাবে। প্রাকৃতিক প্রয়োজন ছাড়া ই‘তিকাফকারী নিজ বাড়ীতে প্রবেশ করবে না।
৯. ক্বদরের রাত্রিগুলিতে ও ই‘তিকাফ অবস্থায় ইবাদত করার নিয়মাবলীঃ
(ক) দীর্ঘ রুকূ ও সিজদার মাধ্যমে বিতরসহ ১১ রাক‘আত তারাবীহ বা তাহাজ্জুদ ছালাত আদায় করা। (খ) প্রয়োজনে একই সূরা, তাসবীহ ও দো‘আ বারবার পড়ে ছালাত দীর্ঘ করা।
(গ) অধিকহারে কুরআন তেলাওয়াত করা।
(ঘ) একনিষ্ঠ চিত্তে দো‘আ-দরূদ ও তওবা-ইস্তেগফার করা। ক্বদরের রাত্রিতে ক্ষমা প্রার্থনার বিশেষ দো‘আ‘আল্লা-হুম্মা ইন্নাকা ‘আফুউভুন তুহিববুল ‘আফওয়া ফা‘ফু ‘আন্নী’ (হে আল্লাহ! তুমি ক্ষমাশীল। তুমি ক্ষমা করতে ভালবাস। অতএব আমাকে ক্ষমা কর) দো‘আটি বেশী বেশী পাঠ করা।
(ঙ) তারাবীহ’র ৮ রাক‘আত ছালাত জামা‘আতের সাথে আদায় করাই উত্তম। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ইমামের সাথে ক্বিয়ামকারী সারা রাত্রি ছালাত আদায়ের নেকী পেয়ে থাকে’।
(চ) জামা‘আতের সাথে ৮ রাক‘আত তারাবীহ শেষে খাওয়া-দাওয়া ও কিছুক্ষণ কুরআন তেলাওয়াতের পর ঘুমিয়ে যাবেন। অতঃপর শেষ রাতে উঠে টয়লেট সেরে এসে তাহিইয়াতুল ওযূ ও তাহিইয়াতুল মসজিদ বা অন্যান্য ছালাত যেমন ছালাতুত তওবাহ, ছালাতুল হাজত, ছালাতুল ইস্তিখারাহ ইত্যাদি নফল ছালাত শেষে ৩ অথবা ৫ রাক‘আত বিতর পড়বেন। অতঃপর সাহারী শেষে ফজরের দু’রাক‘আত সুন্নাত পড়বেন। অতঃপর জামা‘আতে এসে ফজরের ছালাত আদায় করবেন। এরপর ঘুমিয়ে যাবেন।
(ছ) ই‘তিকাফ কালে সকালে ঘুম থেকে উঠে টয়লেট ও গোসল সেরে মসজিদে প্রবেশ করে দু’রাক‘আত তাহিইয়াতুল ওযূ ও দু’রাক‘আত তাহিইয়াতুল মসজিদ আদায় করবেন। এভাবে যতবার টয়লেটে যাবেন, ততবার করবেন। অতঃপর বেলা ১২-টার মধ্যে ২ থেকে সর্বোচ্চ ১২ রাক‘আত পর্যন্ত ছালাতুয যোহা বা চাশতের ছালাত আদায় করবেন। প্রতি ছালাতের শেষ বৈঠকে নিজের ও আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব ও জাতির কল্যাণ চেয়ে আল্লাহর নিকটে দো‘আ করবেন। উক্ত নিয়তে আল্লা-হুম্মা রববানা আ-তিনা ফিদ্দুনিয়া হাসানাতাঁও ওয়া ফিল আ-খিরাতে হাসানাতাঁও ওয়া ক্বিনা আযা-বান্না-র’। অথবা আল্লা-হুম্মা আ-তিনা ফিদ্দুনিয়া ..। ‘হে আল্লাহ! হে আমাদের পালনকর্তা! তুমি আমাদেরকে দুনিয়াতে মঙ্গল দাও ও আখেরাতে মঙ্গল দাও এবং আমাদেরকে জাহান্নামের আযাব থেকে বাঁচাও’। হযরত আনাস (রাঃ) বলেন, এ দো‘আটি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) অধিকাংশ সময় পড়তেন। এ সময় দুনিয়াবী চাহিদার বিষয়গুলি নিয়তের মধ্যে শামিল করবেন। কেননা আল্লাহ বান্দার অন্তরের খবর রাখেন ও তার হৃদয়ের কান্না শোনেন (মুমিন ৪০/১৯)। দো‘আর সময় নির্দিষ্টভাবে কোন বিষয়ের নাম না করাই ভাল। কেননা ভবিষ্যতে বান্দার কিসে মঙ্গল আছে, সেটা আল্লাহ ভাল জানেন।
(জ) দিন-রাত কুরআন তেলাওয়াত, তাফসীর বা অন্যান্য দ্বীনী কিতাব সমূহ অধ্যয়নে রত থাকবেন। বিশেষ করে ‘ছালাতুর রাসূল (ছাঃ)’ বইটি শেষ করুন এবং তাফসীরুল কুরআন (৩০তম পারা) থেকে কমপক্ষে সূরা ফাতিহা, নাবা, আছর ও সূরা তাকাছুর-এর তাফসীর পাঠ করুন।
(ঝ) উচ্চ শব্দে ইবাদত করবেন না। অন্যের ইবাদতে বিঘ্ন ঘটাবেন না।
(ঞ) ক্বদরের রাত্রিগুলিতে মসজিদে দীর্ঘ ওয়ায মাহফিলের ও বিশেষ খানাপিনার আয়োজন করবেন না। যাতে ইবাদতের পরিবেশ বিঘ্নিত হয় আল্লাহ আমাদের তওফীক দান করুন- আমীন!!
📚📖📘📚📖📘📚📖📘📚📖📘📚📖📘📚📖📘📚📖📘📚📖📘📚📖📘📚📖📘
আমার প্রিয় বাংলা বই হোয়াইটসআপ গ্রুপে যুক্ত হতে এখানেক্লিক করুন, টেলিগ্রাম গ্রুপে যুক্ত হতে এখানে ক্লিক করুন এবং ফেইসবুক গ্রুপে যুক্ত হতে এখানে ক্লিক করুন।
No comments:
Post a Comment
আমার প্রিয় বাংলা বই-এর যে কোন লেখাতে যে কোন ত্রুটি বা অসংগতি পরিলক্ষিত হলে দয়া করে আমাদের লিখুন।