বদর যুদ্ধের ঐতিহাসিক পটভূমিঃ সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী - আমার প্রিয় বাংলা বই

সাম্প্রতিকঃ

Post Top Ad

Responsive Ads Here

March 22, 2022

বদর যুদ্ধের ঐতিহাসিক পটভূমিঃ সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী

 

(বদরের যুদ্ধ এবং তার সাথে সম্পর্কিত অবস্থা ও ঘটনাবলীর ঐতিহাসিক বিশ্লেষণ)

নবী (সা) তাঁর দাওয়াতের প্রথম দশ বারো বছর মক্কা ময়াযময়ায় অবস্থান করেছিলেন। এ সময় তাঁর দাওয়াত যথেষ্ট পরিপক্কতা ও স্থিতিশীলতা অর্জন করেছিল। কারণ এর পেছনে সশরীরে উপস্থিত ছিলেন। ইসলামী দাওয়াতের পতাকাবাহী উন্নত চরিত্র ও বিশাল হৃদয়বৃত্তির অধিকারী এক জ্ঞানী পুরুষ। তিনি নিজের ব্যক্তি সত্তার সমস্ত যোগ্যতা ও সামর্থ এ কাজে নিয়োজিত করেছিলেন। তাঁর কার্যধারা থেকে এ সত্যটি পুরোপুরি সষ্পষ্ট হয়ে উঠেছিল যে, এ আন্দোলনকে তার সাফল্যের চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌছে দেবার জন্যে তিনি দৃঢ়সংকল্প । এ লক্ষে উপনীত হবার জন্যে পথের যাবতীয় বিপদ আপদ ও সংকট -সমস্যার মোকাবিলায় তিনি সর্বক্ষন প্রস্তুত। অন্যদিকে এ দাওয়াতের মধ্যে ছিল এমন এক অদ্ভুদ ও তীব্র আকর্ষণী ক্ষমতা যে, হৃদয়-মস্তিষ্কের গভীরে তার অনুপ্রবেশ কার্য চলছিল দ্রুত ও অপ্রতিহত গতিতে। মুর্খতা ও অজ্ঞতার অন্ধকার এবং হিংসা ও সংকীর্ণ স্বার্থপ্রতির প্রাচীন তার পথ রোধ করতে পারছিল না। এ কারণে আরবের প্রাচীন জাহেলী ব্যবস্থার সমর্থক শ্রেনী প্রথম দিকে একে হালকাভাবে এবং অবজ্ঞার চোখে দেখলেও মক্কী যুগের শেষের দিকে একে একটি গুরুতর বিপদ বলে মনে করেছিল। একে নিশ্চিহ্ন করার জন্যে তারা নিজেদের পূর্ণ শক্তি নিয়োগ করতে চাচ্ছিল। কিন্তু তখনো পর্যন্ত এ দাওয়াতের মধ্যে কোন কোন দিক দিয়ে বেশ কিছুটা অভাব রয়ে গিয়েছিল।

একঃ তখনো একথা পুরোপুরি প্রমাণ হয়নি যে, এমন ধরনের যথেষ্ট সংখ্যক অনুসারী এ দাওয়াতের পতাকা তলে সমবেত হয়েছে যারা শুধু তার অনুগতই নয় বরং তার নীতিকে মনেপ্রাণে ভালও বাসে তাকে বিজয়ী ও প্রতিষ্ঠিত করার সংগ্রামে নিজেদের সর্বশক্তি ও সকল উপায় উপকরণ ব্যয় করতে প্রস্তুত এবং এ জন্যে নিজেদের সব কিছু কুরবানী করে দিতে, সারা দুনিয়ার সাথে লড়াই করতে এমন কি নিজেদের প্রিয়তম আত্মীয়তার বাঁধনগুলো কেটে ফেলতে ও উদগ্রিব। যদিও মক্কার ইসলামের অনুসারীরা কুরাইশদের জুলুম -নির্যাতন বরদাশত করে নিজেদের ঈমানের অবিচলতা ও নিষ্ঠা এবং ইসলামের সাথে তাদের অটুট সম্পর্কের পক্ষে বেশ বড় আকারের প্রমাণ পেশ করেছিল, তবুও একথা প্রমাণিত হওয়া তখনো বাকী ছিল যে, ইসলামী আন্দোলন এমন একদল উৎসর্গীত প্রাণ অনুসারী পেয়ে গেছে যারা নিজেদের উদ্দেশ্য ও লক্ষের মোকাবিলায় অন্য কোন জিনিসকেই প্রিয়তর মনে করে না। বস্তুত একথা প্রমাণ করার জন্যে তখনো অনেক পরীক্ষারও প্রয়োজন ছিল।

দুইঃ এ দাওয়াতের আওয়াজ সারাদেশ ছড়িয়ে পড়লেও এর প্রভাবগুলো ছিল চারদিকে বিক্ষিপ্ত ও অসংহত। এ দাওয়াত যে জনশক্তি সংগ্রহ করেছিল তা এলোমেলো অবস্থায় সারাদেশে ছড়িয়ে ছিল। পুরাতন জাহেলী ব্যবস্থার সাথে চূড়ান্ত মোকাবিলা করার জন্যে যে ধরনের সামষ্টিক শক্তির প্রয়োজন ছিল তা সে তখনো অর্জন করেনি।

তিনঃ এ দাওয়াত তখনো মাটিতে কোথাও শিকড় গাড়তে পারেনি। তখণো তা কেবল বাতাসেই উড়ে বেড়াচ্ছিল। দেশের অভ্যন্তরে এমন কোন এলাকা ছিল না যেখানে দৃঢ়পদ হয়ে নিজের ভূমিকাকে সুসংহত করে সে সামনের দিকে এগিয়ে যাবার জন্যে প্রচেষ্টা চালাতে পারতো। তখনো পর্যন্ত যেখানেই যে মুসলমান ছিল, কুফর ও শিরকে নিমজ্জিত সমাজ ব্যবস্থার মধ্যে তার অবস্থান ছিল ঠিক খালি পেটে গেলা, কুইনিনের মত। অর্থাৎ খালি পেটে কুইনিন গিললে পেট তাকে বমি করে উগরে দেবার জন্যে সর্বক্ষণ চাপ দিতে থাকে এবং কোথাও তাকে এক দণ্ড তিষ্টাতে দেয় না।

চারঃ সে সময় পর্যন্ত এ দাওয়াত বাস্তব জীবনের কার্যাবলী নিজের হাতে পরিচালনা করার সুযোগ পায়নি। তখনো সে তার নিজস্ব সভ্যতা সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠায় সক্ষম হয়নি। নিজস্ব অর্থনৈতিক, সামাজিক, ও রাজনৈতিক, ব্যবস্থা রচনাও তার পক্ষে সম্ভব হয়নি। অন্যান্য শক্তির সাথে তার যুদ্ধ ও সন্ধির কোন ঘটনাই ঘটেনি। তাই যেসব নৈতিক বিধানের ভিত্তিতে এ দাওয়াত সমগ্র দেশ ও সমাজকে প্রতিষ্ঠিত ও পরিচালিত করতে চাচ্ছিল তার কোন প্রদর্শনীও করা যায়নি। আর এ দাওয়াতের বানী বাহক ও তার অনুসারীরা যে জিনিসের দিকে সমগ্র দুনিয়াবাসীকে আহবান জানিয়ে আসছিলেন তাকে কার্যকর করার ব্যাপারে তারা নিজেরা কতটুকু নিষ্ঠাবান, এখনো কোন পরীক্ষার মানদণ্ডে যাচাই বাছাই করার পর তার সুষ্পষ্ট চেহারাও সামনে আসেনি।

মক্কী যুগের শেষ তিন-চার বছরে ইয়াসরেবে ইসলামের আলো ছড়িয়ে থাকে অপ্রতিহত গতিতে। সেখানকার লোকেরা আরবের অন্যান্য এলাকার গোত্রগুলোর তুলনায় অধিকতর সহজে ও নির্দ্বিধায় এ আলো গ্রহণ করতে থাকে।শেষে নবুওয়াতের দ্বাদশ বছরে হজ্জের সময় ৭৫ জনের একটি প্রতিনিধি দল রাতের আঁধারে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে সাক্ষাত করলো, তারা কেবল ইসলাম গ্রহণই করেননি বরং তাকে ও তার অনুসারীদেরকে নিজেদের শহরে স্থান দেয়ার ও আগ্রহ প্রকাশ করলেন। এটি ছিল ইসলামের ইতিহাসের একটি বৈপ্লবিক পটপরিবর্তন। মহান আল্লাহ তার নিজ অনুগ্রহে এ দুর্লভ সুযোগটি দিয়েছিলেন এবং নবী (সা) ও হাত বাড়িয়ে তা লুফে নিয়েছিলেন। ইয়াসরেববাসীরা নবী(সা) কে শুধুমাত্র একজন শরণার্থী হিসেবে নয় বরং আল্লাহর প্রতিনিধি এবং নেতা ও শাষক হিসেবেও আহবান করেছিলেন। আর তার অনুসারীদেরকে তারা একটি অপরিচিতি দেশে নিছক মুহাজির হিসেবে বসবাস করার জন্যে আহবান জানাচ্ছিলেন না। বরং আরবের বিভিন্ন এলাকায় ও বিভিন্ন গোত্রের মধ্যে যেসব মুসলমানদের সাথে মিলে একটি সুসংবদ্ধ সমাজ গড়ে তোলাই ছিল এর উদ্দেশ্য। এভাবে মূলত ইয়াসরেব নিজেকে মদীনাতুল ইসলাম তথা ইসলামের নগর হিসেবে উপস্থাপিত করলো। নবী(সা) তাদের আহবানে সাড়া দিয়ে সেখানে আরবের প্রথম দারুল ইসলাম গড়ে তুললেন।

এ ধরনের উদ্যেগ গ্রহণের অর্থ কি হতে পারে সে সম্পর্কে মদীনাবাসীরা অনবহিত ছিল না। এর পরিস্কার অর্থ ছিল, একটি ছোট্র শহর সারাদেশের উদ্যত তরবারি এবং সমগ্র দেশবাসীর অর্থনৈতিক, সামাজিক , ও সাংস্কৃতিক বয়কটের মোকাবিলায় নিজেকে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল। কাজেই আকাবার বাইআত গ্রহণ করার সময় সেদিনের সেই রাত্রীকালীন মজলিসে ইসলামের প্রাথমিক সাহায্যকারী (আনসারগণ) এ পরিণাম সম্পর্কে পুরোপুরি জেনে বুঝেই নবী (সা) এর হাতে নিজেদের হাত রেখেছিলেন। যখন এ বাইআত অনুষ্ঠিত হচ্ছিল ঠিক তখনই ইয়াসরেবী প্রতিনিধি দলের সর্বকনিষ্ঠ যুব সদস্য আস’আদ ইবনে যুরারাহ (রা) উঠে বললেনঃ

رُوَيدًا يا أهلَ يَثرِبَ، إنَّا لم نَضرِبْ إليه أكْبادَ المَطيِّ إلَّا ونحن نَعلَمُ أنَّه رسولُ اللهِ، إنَّ إخْراجَه اليومَ مُفارَقةُ العَرَبِ كافَّةً، وقَتْلُ خيارِكُم، وأنْ تَعَضَّكُم السُّيوفُ، فإمَّا أنتم قَومٌ تَصْبِرون على السُّيوفِ إذا مَسَّتْكُم، وعلى قَتْلِ خيارِكُم، وعلى مُفارَقةِ العَرَبِ كافَّةً، فخُذوه وأجْرُكُم على اللهِ، وإمَّا أنتُم قَومٌ تَخافون مِن أنفُسِكُم خيفةً فذَروه، فهو أعْذَرُ عِندَ الله

থামো, হে ইয়াসরেব বাসীরা! আমরা একথা জেনে বুঝেই এঁর কাছে এসেছি যে, ইনি আল্লাহর রসূল এবং আজ এখান থেকে বের করে নিয়ে যাওয়া মানে হচ্ছে সমগ্র আরববাসীর শত্রুতার ঝুঁকি নেয়া। এর ফলে তোমাদের শিশু সন্তানদেরকে হত্যর করা হবে এবং তোমাদের ওপর তরবারি বর্ষিত হবে। কাজেই যদি তোমাদের এ আঘাত সহ্য করার ক্ষমতা থাকে তাহলে এঁর দায়িত্ব গ্রহণ করো। আল্লাহ এর প্রতিদান দেবেন। আর যদি তোমরা নিজেদের প্রাণকে প্রিয়তর মনে করে থাকো তাহলে দায়িত্ব ছেড়ে দাও এবং পরিষ্কার ভাষায় নিজেদের অক্ষমতা জানিয়ে দাও। কারণ এ সময় অক্ষমতা প্রকাশ করা আল্লাহর কাছে বেশী গ্রহণযোগ্য হতে পারে”।

প্রতিনিধি দলের আর একজন সদস্য আব্বাস ইবনে উবাদাহ ইবনে নাদলাহ (রা) একথারই পুনরাবৃত্তি করেন এভাবেঃ

هَلْ تَدْرُونَ عَلامَ تُبَايِعُونَ هَذَا الرَّجُلَ ؟ قَالُوا : نَعَمْ ، قَالَ : إِنَّكُمْ تُبَايِعُونَ عَلَى حَرْبِ الأَحْمَرِ وَالأَسْوَدِ مِنَ النَّاسِ ، وَإِنْ كُنْتُمْ تَرَوْنَ أَنَّكُمْ إِذَا نَهَكَتْ أَمْوَالَكُمْ مُصِيبَةٌ ، وَأَشْرَافُكُمْ قَتْلَى أَسْلَمْتُمُوهُ ، فَمِنَ الآنَ فَهُوَ وَاللَّهِ إِنْ فَعَلْتُمْ خِزْيُ الدُّنْيَا وَالآخِرَةِ ، وَإِنْ كُنْتُمْ تَرَوْنَ أَنَّكُمْ وَافُونَ لَهُ بِمَا دَعَوْتُمُوهُ إِلَيْهِ عَلَى نُهْكَةِ الأَمْوَالِ وَقَتْلِ الأَشْرَافِ فَخُذُوهُ ، فَهُوَ وَاللَّهِ خَيْرُ الدُّنْيَا وَالآخِرَةِ ، 

তোমরা কি জানো, এ ব্যক্তির হাতে কিসের বাইআত করছো? (ধ্বনিঃ হাঁ আমরা জানি) তোমরা এঁর হাতে বাইআত করে সারা দুনিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার ঝুঁকি নিচ্ছো।কাজেই যদি তোমরা মনে করে থাকো, যখন তোমাদের ধন-সম্পদ ধ্বংসের মুখোমুখি হবে এবং তোমাদের নেতৃস্থানীয় লোকদের নিহত হবার আশংকা দেখা দেবে তখন তোমরা এঁকে শত্রুদের হাতে সোপর্দ করে দেবে, তাহলে আজই বরং এঁকে ত্যাগ করাই ভাল। কারণ আল্লাহর কসম,এটা দুনিয়ায় ও আখেরাতের সবখানেই লাঞ্চনার কারণ হবে। আর যদি তোমরা মনে করে থাকো, এ ব্যক্তিকে তোমরা যে, আহবান জানাচ্ছো, নিজেদের ধন-সম্পদ ধ্বংস ও নেতৃস্থানীয় লোকেদের জীবন নাশ সত্ত্বেও তোমরা তা পালন করতে প্রস্তুত থাকবে, তাহলে অবশ্যি তাঁর হাতে আকড়ে ধরো। কারণ আল্লাহর কসম, এরই মধ্যে রয়েছে দুনিয়া ও আখেরাতের কল্যাণ”।

একথায় প্রতিনিধি দলের সবাই এক বাক্যে বলে উঠলেনঃ

فَإِنَّا وَاللَّهِ نَأْخُذُهُ عَلَى مُصِيبَةِ الأَمْوَالِ وَقَتْلِ الأَشْرَافِ

আমরা এঁকে গ্রহণ করে আমাদের ধন-সম্পদ ধ্বংস করতে ও নেতৃস্থানীয় লোকদের নিহত হবার ঝুকি নিতে প্রস্তুত”।

এ ঘটনার পর সেই ঐতিহাসিক বাইআত অনুষ্ঠিত হয়। ইতিহাসে একে আকাবার দ্বিতীয় বাইআত বলা হয়।

অন্যদিকে মক্কাবাসীদেরক কাছেও এ ঘটনাটির তাৎপর্য ছিল সুবিদিত। ইতিপূর্বে কুরাইশরা মুহাম্মাদ (সা) এর বিপুল প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব ও অসাধারণ যোগ্যতার সাথে পরিচিত হয়েছিল এবং এখন সেই মুহাম্মাদই (সা) যে, একটি আবাস লাভ করতে যাচ্ছিলেন তা তারা বেশ অনুধাবন করতে পারছিল। তাঁর নেতৃত্বে ইসলামের অনুসারীরা যে একটি সুসংগঠিত দলের আকারে অচিরেই গড়ে উঠবে এবং সমবেত হবে একথাও তারা বুঝতে পারছিল। আর ইসলামের এ অনুসারীরা সংকল্পে কত দৃঢ়, নিষ্ঠা ও আত্মত্যাগে কত অবিচল, এতদিনে সেটা তাদের কাছে অনেকটা পরীক্ষিত হয়ে গিয়েছিল। এহেন সত্যাভিসারী কাফেলার এ নব উত্থান পুরাতন ব্যবস্থার জন্যে মৃত্যুর ঘন্টাস্বরূপ। তাছাড়া মদীনার মত জায়গায় এই মুসলিম শক্তির একত্র সমাবেশ কুরাইশদের জন্যে আরো নতুন বিপদের সংকেত দিচ্ছিল। কারণ লোহিত সাগরের কিনারা ধরে ইয়ামন থেকে সিরিয়ার দিকে যে বানিজ্য পথটি চলে গিয়েছিল তার সংরক্ষিত ও নিরাপদ থাকার ওপর কুরাইশ ও অন্যাণ্য বড় বড় গোত্রের অর্থনৈতিক জীবন নির্ভরশীল ছিল। আর এটি এখন মুসলমানদের প্রভাবাধীনে চলে যাওয়া প্রায় নিশ্চিত। এ প্রধান বাণিজ্য পথটি দখল করে মুসলমানরা জাহেলী ব্যবস্থার জীবন ধারণ দুর্বিসহ করে তূলতে পারতো।এ প্রধান বাণিজ্য পথের ভিত্তিতে শুধু মাত্র মক্কাবাসীদের যে ব্যবসায় চলতো তার পরিমাণ ছিল বছরে আড়াই লাখ আশরাফী। তায়েফ ও অন্যান্য স্থানের ব্যবসায় ছিল এর বাইরে।

কুরাইশরা এ পরিণতির কথা ভালভাবেই জানতো। যে রাতে আকাবার বাইআত অনুষ্ঠিত হলো সে রাতেই এ ঘটনার উড়ো খবর মক্কাবাসীদের কানে পৌছে গোলো। আর সাথে সাথেই সেখানে হৈ চৈ শুরু হয় গেলো। প্রথমে তারা চেষ্টা করলো মদীনাবাসীদেরকে নবী (সা) এর দল থেকে ভাগিয়ে নিতে। তারপর যখন মুসলমানরা একজন দুজন করে মদিনায় হিজরত করতে থাকলো এবং কুরাইশদের দৃঢ় বিশ্বাস জন্মে গেলো যে, এখন মুহাম্মাদ (সা) সেখানে স্থানন্তরিত হয়ে যাবেন তখন তারা এ বিপদকে ঠেকিয়ে রাখার জন্যে সর্বশেষ উপায় অবলম্বনে এগিয়ে এলো। রসূলের (সা) হিজরতের মাত্র কয়েক দিন আগে কুরাইশদের পরিমর্শ সভা বসলো। অনেক আলোচনা পর্যালোচানার পর সেখানে স্থির হলো, বনী হাশেম ছাড়া কুরাইশদের প্রত্যেক গোত্র থেকে একজন করে লোক বাচাই করা হবে এবং এরা সবাই মিলে মুহাম্মাদ (সা)কে হত্যা করবে। এর ফলে বনী হাশেমের জন্যে এ সমস্ত গোত্রের সাথে একাকী লড়াই করা কঠিন হবে। কাজেই এ ক্ষেত্রে তারা প্রতিশোধের পরিবর্তে রক্ত মূল্য গ্রহণ করতে বাধ্য হবে। কিন্তু আল্লাহর মেহেরবানী এবং নবী (সা) এর আল্লাহর ওপর নির্ভরতা ও উন্নত কৌশল অবলম্বনের কারণে তাদের সব চক্রান্ত ব্যর্থ হয়ে গেলো। ফলে রসূলুল্লাহ (সা)নির্বিঘ্নে মদীনায় পৌছে গেলেন।এভাবে হিজরত প্রতিরোধ ব্যর্থ হয়ে কুরাইশরা মদীনার সরদার আবুদুল্লাহ ইবনে উবাই কে(যাকে হিজরতের আগে মদীনাবাসীরা নিজেদের বাদশাহ বানাবার প্রস্তুতি নিয়েছিল এবং রসূলের মদীনায় পৌছে যাবার এবং আওস ও খাযরাজদের অধিকাংশের ইসলাম গ্রহণের ফলে যার বাড়া ভাতে ছাই পড়ে গিয়েছিল) পত্র লিখলোঃ তোমারা আমাদের লোককে তোমাদের ওখানে আশ্রয় দিয়েছো। আমরা এ মর্মে আল্লাহর কসম খেয়েছি, হয় তোমরা তার সাথে লড়বে বা তাকে সেখান থেকে বের করে দেবে। অন্যথায় আমরা সবাই মিলে তোমাদের ওপর আক্রমণ করবো এবং তোমাদের পুরুষদেরকে হত্যা ও মেয়েদেরকে বাদী বানাবো। কুরাইশদের এ উষ্কানির মুখে আবুদুল্লাহ ইবনে উবাই কিছু দুষ্কর্ম করার চক্রান্ত এঁটেছিল। কিন্তু সময় মত নবী (সা) তার দুষ্কর্ম রুখে দিলেন। তারপর মদীনার প্রধান সাদ ইবনে মুআয উমরাহ করার জন্যে মক্কা গেলেন । সেখানে হারম শরীফের দরজার ওপর আবু জেহেল তার সমালোচনা করে বললোঃ

ألَا أرَاكَ تَطُوفُ بمَكَّةَ آمِنًا، وقدْ أوَيْتُمُ الصُّبَاةَ، وزَعَمْتُمْ أنَّكُمْ تَنْصُرُونَهُمْ وتُعِينُونَهُمْ، أما واللَّهِ لَوْلَا أنَّكَ مع أبِي صَفْوَانَ ما رَجَعْتَ إلى أهْلِكَ سَالِمًا،

তোমরা আমাদের ধর্মত্যাগীদের আশ্রয় দেবে এবং তাদেরকে সাহায্য -সহযোগীতা দান করবে আর আমরা তোমাদেরকে অবাধে মক্কায় তাওয়াফ করতে দেবো ভেবেছ? যদি তুমি আবু সফওয়ান তথা উমাইয়া ইবনে খলফের মেহমান না হতে তাহলে তোমাকে এখান থেকে প্রাণ নিয়ে দেশে ফিরে যেতে দিতাম না”।

সাদ জবাবে বললেনঃ

واللَّهِ لَئِنْ مَنَعْتَنِي هذا لَأَمْنَعَنَّكَ ما هو أشَدُّ عَلَيْكَ منه، طَرِيقَكَ علَى المَدِينَةِ

আল্লাহর কসম, যদি তুমি আমাকে এ কাজে বাধা দাও তাহলে আমি তোমাকে এমন জিনিস থেকে রুখে দেবো, যা তোমার জন্যে এর চাইতে অনেক বেশী মারাত্মক। অর্থাৎ মদীনা দিয়ে তোমাদের যাতায়াতের পথ বন্ধ করে দেবো”

অর্থাৎ এভাবে মক্কাবাসীদের পক্ষ থেকে যেন একথা ঘোষণা করে দেয়া হলো যে, বায়তুল্লাহ যিয়ারত করার পথ মুসলমানদের জন্যে বন্ধ। আর এর জবাবে মদীনাবাসীদের পক্ষ থেকে বলা হলো, সিরিয়ার সাথে বাণিজ্য করার পথ ইসলাম বিরোধীদের জন্যে বিপদসংকুল।

আসলে সে সময় মুসলমানদের জন্য উল্লেখিত বাণিজ্য পথের ওপর নিজেদের কর্তৃত্ব মজবুত করা ছাড়া দ্বিতীয় কোন উপায় ছিল না। কারণ এ পথের সাথে কুরাইশ ও অন্যান্যগোত্রগুলোর স্বার্থ বিজড়িত ছিল। ফলে এর ওপর মুসলমানদের কৃত্বৃত্ব বেশী মজবুত হলে তারা ইসলাম ও মুসলমানদের ব্যাপারে নিজেদের শত্রুতামূলক নীতি পুনর্বিবেচনা করতে বাধ্য হতে পারে বলে আশা করা যায়। কাজেই মদীনায় পৌছার সাথে সাথেই নবী (সা) সদ্যজাত ইসলামী সমাজে প্রাথমিক নিয়ম -শৃংখলা বিধান ও মদীনার ইহুদী অদিবাসীদের সাথে চুক্তি সম্পাদন করার পর সর্বপ্রথম এ বাণিজ্য পথটির প্রতি নজর দিলেন। এ ব্যাপারে তিনি দুটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যবস্থা অবলম্বন করলেন।

প্রথমত মদীনা ও লোহিত সাগরের উপকূলের মধ্যবর্তীস্থলে এ বাণিজ্য পথের আশেপাশে যেসব গোত্রের বসতি ছিল তাদের সাথে তিনি আলাপ- আলোচনা শুরু করে দিলেন। এভাবে তাদেরকে সহযোগিতামূলক মৈত্রী অথবা কমপক্ষে নিরপেক্ষতার চুক্তিতে আবদ্ধ করা ছিল মূল উদ্দেশ্য । এ ক্ষেত্রে তিনি পূর্ণ সাফলতা লাভ করলেন। সর্বপ্রথম নিরপেক্ষতার চুক্তি অনুষ্ঠিত হলো সাগর তীরবর্তী পার্বত্র এলাকার জুহাইনা গোত্রের সাথে। এ গোত্রটির ভূমিকা এ এলাকায় ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তারপর প্রথম হিজরীর শেষের দিকে চুক্তি অনুষ্ঠিত হলে বনী যামরার সাথে। এ গোত্রটির অবস্থান ছিল ইয়াম্বু ও যুল আশীরার সন্নিহিত স্থানে এটি ছিল প্রতিরক্ষামূলক সহযোগিতার চুক্তি। দ্বিতীয় হিজরীর মাঝামাঝি সময়ে বনী মুদলিজও এ চুক্তিতে শামিল হলো। কারণ এ গোত্রটি ছিল বনী যামরার প্রতিবেশী ও বন্ধু গোত্র। এ ছাড়াও ইসলাম প্রচারের ফলে এ গোত্রগুলোতে ইসলামের সমর্থক ও অনুসারীদের একটি বিরাট গোষ্ঠি সৃষ্টি হয়ে গিয়েছিল।

দ্বিতীয়ত কুরাইশদের সওদাগরী কাফেলাগুলোকে ভীত -সন্ত্রস্ত করে তোলার জন্যে বাণিজ্য পথের ওপর একের পর এক ছোট ছোট ঝাটিকা বাহিনী পাঠাতে থাকলেন।কোন কোন ঝাটিকা বাহিনীর সাথে তিনি নিজেও গেলেন। প্রথম বছর এ ধরনের ৪টি বাহিনী পাঠানো হলো। মাগাযী (যুদ্ধ ইতিহাস) গ্রন্থগুলো এগুলোকে সারীয় হামযা, সারীয়া, উবাইদা ইবনে হারেস, সারীয়া সাদ ইবনে আবী ওয়াক্কাস ও গাযওয়া তুল আবওয়া নামে অভিহিত করা হয়েছে।

(ইসলামের ইতিহাসের পরিভাষায় সীরিয়া বলা হয় এমন ধরনের ছোটখাট বাহিনীকে যাকে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কোন সাহাবীর নেতৃত্বে পাঠিয়ে ছিলেন আর যে বাহিনীতে তিনি নিজে গিয়েছিলেন তাকে বলা হয় গাযওয়া।)

দ্বিতীয় বছরের প্রথম দিকের মাসগুলোর একই দিকে আরো দুটি আক্রমণ চালানো হলো। মাগাযী গ্রন্থগুলোয় এ দুটিকে গাযওয়া বুওয়াত ও গাযওয়া যুল আশারী নামে উল্লেখ করা হয়েছে। এ সমস্ত অভিযানের দুটি বৈশিষ্ট উল্লেখযোগ্য । এক, এ অভিযানগুলোয় কোন রক্তপাতের ঘটনা ঘটেনি এবং কোন কাফেলা লুণ্ঠিত ও হয়নি। এ থেকে একথা পরিষ্কার হয়ে যায় যে, এর মাধ্যমে কুরাইশদেরকে বাতাসের গতি কোন দিকে তা জানিয়ে দেয়াই ছিল আসল উদ্দেশ্য। দুই , এর মধ্য থেকে কোন একটি বাহিনীতেও নবী (সা) মদীনার একটি লোককেও শামিল করেননি। মক্কা থেকে আগত মুহাজিরদেরকেই তিনি এসব বাহিনীর অন্তরভুক্ত করেন। কারণ এর ফলে যদি সংঘর্ষ বাধে তাহলে তা যেন এর সাথে চড়িয়ে পড়ে এ আগুনকে চারদিকে ছাড়িয়ে না দেয়। ওদিকে মক্কাবাসীরাও মদীনার দিকে লুটেরা বাহিনী পাঠাতে থাকে। তাদেরই একটি বাহিনী কুরয ইবনে জাবের আল ফিহরীর নেতৃত্বে একেবারে মদীনার কাছাকাছি এলাকায় হামলা চালিয়ে মদীনাবাসীদের গৃহপালিত পশু লুট করে নিয়ে যায়। এ ব্যাপারে কুরাইশরা এ সংঘর্ষের মধ্যে অন্যান্য গোত্রদেরকেও জড়িয়ে ফেলার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিল। তাছাড়া তারা কেবল ভয় দেখিয়েই ক্ষান্ত হচ্ছিল না , লুটতরাজও শুরু করে দিয়েছিল।

এ অবস্থায় ২য় হিজরীর শাবান মাসে(৬২৩ খৃষ্টব্দের ফেব্রুয়ারী বা মার্চ মাস)কুরাইশদের একটি বিরাট বানিজ্য কাফেলা সিরিয়া থেকে মক্কার পথে অগ্রসর হয়ে এমন এক জায়গায় পৌছে গিয়েছিল যে জায়গাটি ছিল মদীনাবাসীদের আওতার মধ্য। এ কাফেলার সাথে ছিল প্রায় ৫০ হাজার আশরাফীর সামগ্রী। তাদের সাথে তিরিশ চল্লিশ জনের বেশী রক্ষী ছিল না। যেহেতু পণ্যসামগ্রী ছিল বেশী এবং রক্ষীর সংখ্যা ছিল কম আর আগের অবস্থার কারণে মুসলমানদের কোন শক্তিশালী দলের তাদের ওপর অতর্কিত আক্রমণ করার আশংকা ছিল অত্যন্ত প্রবল, তাই কাফেলা সরদার আবু সুফিয়ান এ বিপদ সংকুল স্থানে পৌছেই সাহায্য আনার জন্য কোন এক ব্যক্তিকে মক্কা অভিমূখে পাঠিয়ে দিল। লোকটি মক্কায় পৌছেই প্রাচীন প্রথা অনুযায়ী নিজের উটের কান কেটে ফেললো, তার নাক চিরে দিল, উটের পিঠের আসন উল্টে দিলে এবং নিজের জামা সামনের দিকে ও পিছনের দিকে ছিড়ে ফেলে এই বলে চিৎকার করতে থাকলোঃ

يا معشر قريش اللطيمة اللطيمة، أموالكم مع أبي سفيان قد عرض لها محمد في أصحابه لا أرى أن تدركوها، الغوث الغوث.

হে কুরাইশরা! তোমাদের বাণিজ্য কাফেলার খবর শোনো। আবু সুফিয়ানের সাথে তোমাদের যে সম্পদ আছে, মুহাম্মাদ তার সঙ্গীসাথীদের নিয়ে তার পেছনে ধাওয়া করেছে। তোমাদের তা পাবার আশা নেই। সাহায্যের জন্যে দৌড়ে চলো! সাহায্যের জন্যে দৌড়ে চলো”।!

এ ঘোষনা শুনে সারা মক্কার বিরাট আলোড়ন সৃষ্টি হয়ে গোলো। কুরাইশদের বড় বড় সরদাররাই সবাই যুদ্ধের জন্যে তৈরী হলো। প্রায় এক হাজার যোদ্ধা রণসাজে সজ্জিত হয়ে পূর্ণ আড়ম্বর ও জাঁক -জমকের সাথে যুদ্ধ ক্ষেত্রে রওয়ানা হলো। তাদের মধ্যে ছিল ৬শ বর্মধারী এবং একশ জন অশ্বারোহী। নিজেদের কাফেলাকে শুধু নিরাপদে মক্কায় ফিরিয়ে নিয়ে আসাই তাদের কাজ ছিল না বরং এই সংগে তারা নিত্য দিনের এ আশংকা ও আতংকবোধকে চিরতরে খতম করে দিতে চাচ্ছিল। মদীনায় এ বিরোধী শক্তির নতুন সংযোজনকে তারা গুড়িয়ে দিতে এবং এর আশপাশের গোত্রগুলোকে এর দূর সন্ত্রন্ত করে তুলতে চাচ্ছিল যার ফলে ভবিষ্যতে এ বানিজ্য পথটি তাদের জন্যে সম্পূর্ণ নিরাপদ হয়ে যায়।

নবী (সা) চলমান ঘটনাবলীর প্রতি সবসময় সজাগ দৃষ্টি রাখতেন। তিনি উদ্ভুত পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটি অনুভব করলেন যেন চূড়ান্ত মীমাংসার সময় এসে গেছে। তিনি ভাবলেন এ সময় যদি একটি সাহসী পদক্ষেপ গ্রহণ না করা হয় তাহলে ইসলামী আন্দোলন চিরকালের জন্যে নিষ্প্রাণ হয়ে পড়বে। বরং এরপর এ আন্দোলনের জন্যে হয়ত আবার মাথা উচু করে দাড়াবার আর কোন সুযোগই থাকবে না। মক্কা থেকে হিজরত করে এ নতুন শহরে আসার পর এখনো দুটি বছরও পার হয়ে যায়নি। মুহাজিররা বিত্ত ও সরঞ্জামহীন, আনসাররা অনভিজ্ঞ , ইহুদীগোত্রগুলো বিরুদ্ধাবাদিতায় মুখর খোদ মদীনাতেই মুনাফিক ও মুশরিকদের একটি বিরাট গোষ্ঠি উপস্থিত এবং চারপাশের সমস্ত গোত্র কুরাইশদের ভয়ে ভীত। আর সেই সংগে ধর্মীয় দিক দিয়েও তাদের প্রতি সহানুভূতিশীল। এ অবস্থায় যদি কুরাইশরা মদীনা আক্রমণ করে তাহলে মুসলমানদের এ ক্ষুদ্র দলটি নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতে পারে। কিন্তু যদি তারা মদীনা আক্রমণ না করে শুধু মাত্র নিজেদের শক্তি প্রয়োগ করে বাণীজ্য কাফেলাকে উদ্ধার করে নিয়ে যায় এবং মুসলমানরা দমে গিয়ে ঘরের কোণে হাত পা গুটিয়ে বসে থাকে তাহলেও সহসাই মুসলমানদের প্রতিপত্তি এমনভাবে আহত হবে এবং তাদের প্রভাব এত বেশী ক্ষুণ্ন হবে যার ফলে আরবের প্রতিটি শিশুও তাদের বিরুদ্ধে দুঃসাহসী হয়ে উঠবে। সারা দেশে তাদের কোন আশ্রয় স্থল থাকবে না। তখন চারপাশের সমস্ত গোত্র কুরাইশদের ইংগিতে কাজ করতে থাকবে। মদীনার ইহুদী , মুনাফীক ও মুশরিকরা প্রকাশ্যে মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে। মদীনায় জীবন ধারণ করাও সে সময় দুসাধ্য হয় পড়বে। মুসলমানদের কোন প্রভাব প্রতিপত্তি থাকবে না। ফলে তাদের ধন-প্রাণ-ইজ্জত -আবরুর উপর আক্রমন চালাতে কেউ ইতস্তত করবে না। এ কারণে (সা) দৃঢ় সংকল্প নিলেন যে, বর্তমানে যতটুকু শক্তি -সামর্থ আমাদের আছে তাই নিয়েই আমরা বের হয়ে পড়বো।দুনিয়ার বুকে বেঁচে থাকার ও টিকে থাকার ক্ষমতা কার আছে এবং কার নেই ময়দানেই তার ফায়সালা হয়ে যাবে।

এ চূড়ান্ত পদক্ষেপ নেবার সংকল্প করেই তিনি আনসার ও মোহাজিরদের একত্র করলেন। তাদের সামনে পরিস্থিতি পরিস্কার তূলে ধরলেন। একদিকে উত্তরে বাণিজ্য কাফেলা এবং অন্যদিকে দক্ষিনে এগিয়ে আসছে কুরাইশদের সেনাদল। আল্লাহর ওয়াদা এ দুটির মধ্য থেকে কোন একটি তোমরা পেয়ে যাবে। তিনি জিজ্ঞেস করলেনঃ বলো, এর মধ্য থেকে কার মোকাবিলায় তোমরা এগিয়ে যেতে চাও? জবাবে বিপুল সংখ্যক সাহাবী মত প্রকাশ করলেন, কাফেলার ওপর আক্রমণ চালানো হোক। কিন্তু নবী (সা) এর সামনে ছিল অন্য কিছু অভিপ্রায়। তাই তিনি নিজের প্রশ্নের পুনরাকৃত্তি করলেন। একথায় মোহাজিরদের মধ্য থেকে মিকদাদ ইবনে আমর (রা) উঠে বললেনঃ

 يا رسول الله، امض لما أمرك الله فانا معك حيثما احببت، لا نقول لك كما قال بنو إسرائيل لموسى : اذهب أنت وربك فقاتلا ، إنا ههنا قاعدون، ولكن اذهب أنت وربك فقاتلا إنا معكما مقاتلون، مادامت عين مناتطرف.

হে আল্লাহর রসূল! আপনার রব আপনাকে যেদিকে যাবার হুকুম দিচ্ছেন সেদিকে চলুন। আপনি যেদিকে যাবেন আমরা আপনার সাথে আছি। আমরা বনী ইসরাঈলের মত একথা বলবো নাঃ যাও তুমি তোমার আল্লাহ দুজনে লড়াই করো, আমরা তো এখানেই বসে রইলাম। বরং আমরা বলছিঃ চলুন আপনি ও আপনার আল্লাহ দুজনে লড়ুন আর আমরা ও আপনাদের সাথে জানপ্রাণ দিয়ে লড়াই করবো। যতক্ষণ আমাদের একটি চোখের তারাও নড়াচড়া করতে থাকবে ততক্ষণ পর্যন্ত” ।

কিন্তু আনসারদের মতামত না জেনে লড়াইয়ের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা সম্ভবপর ছিল না। কারণ এ পর্যন্ত যেসব সামরিক পদক্ষেপ নেয়া হয়েছিল তাতে তাদের সাহায্য গ্রহণ করা হয়নি এবং প্রথম দিন তারা ইসলামকে সমর্থন করার যে শপথ নিয়েছিল তাকে কার্যকর করতে তারা কতটুকু প্রস্তুত তা পরীক্ষা করার এটি ছিল প্রথম সুযোগ। সুতরাং রসূলুল্লাহ (সা) সরাসরি তাদেরকে সম্বোধন না করে নিজের কথার পুনরাবৃত্তি করলেন । একথায় সাদ ইবনে মুআয উঠে বললেন, সম্ভবত আপনি আমাদের সম্বোধন করে বলছেন? জবাব দিলেনঃ হাঁ। একথা শুনে সাদ বললেনঃ

فقد آمنا بك، فصدقناك، وشهدنا أن ما جئت به هو الحق، وأعطيناك على ذلك عهودنا ومواثيقنا على السمع والطاعة، فامض يا رسول الله لما أردت فو الذي بعثك بالحق لو استعرضت بنا هذا البحر فخضته لخضناه معك، ما تخلف منا رجل واحد، وما نكره أن تلقى بنا عدوًّا غدًا إنا لصبر في الحرب، صدق في اللقاء، ولعل الله يريك منا ما تقر به عينك، فسر بنا على بركة الله

আমরা আপনার ওপর ঈমান এনেছি। আপনি যা কিছু এনেছেন তাকে সত্য বলে ঘোষনা করেছি। আপনার কথা শুনার ও আপনার আনুগত্য করার দৃঢ় শপথ নিয়েছি। কাজেই হে আল্লাহর রসূল! আপনি যা সংকল্প করেছেন তা করে ফেলুন। সেই সত্তার কসম! যিনি আপনাকে সত্য সহকারে পাঠিয়েছেন, আপনি যদি আমাদের নিয়ে সমুদ্রে ঝাঁপ দেন তালে আমরাও আপনার সাথে সমুদ্রে ঝাঁপিয়ে পড়বো। আমাদের একজনও পিছনে পড়ে থাকবে না। আপনি কালই আমাদের দুশমনদের সাথে যুদ্ধ শুরু করুন।এটা আমাদের কাছে মোটেই অপছন্দনীয় নয়। আমরা যুদ্ধে অবিচল ও দৃঢ়পদে থাকবো।মোকাবিলায় আমরা সত্যিকার প্রাণ উৎসর্গীতার প্রমাণ দেবো। সম্ভবত আল্লাহ আমাদের থেকে আপনাকে এমন কিছু কৃতিত্ব দেখিয়ে দেবেন, যাতে আপনার চোখ শীতল হবে। কাজেই আল্লাহর বরকতের ভরসায় আপনি আমাদের নিয়ে চলুন”।

এ আলোচনা ও বক্তৃতার পরে সিদ্ধান্ত হলো, বাণিজ্য কাফেলার পরিবর্তে কুরাইশ সেনা দলের মোকাবিলা করার জন্যে এগিয়ে যাওয়া উচিত।কিন্তু এটা কোন যেন তেন সিদ্ধান্ত ছিল না।এ সংক্ষিপ্ত সময়ে যারা যুদ্ধ করতে এগিয়ে এলেন, তাদের সংখ্যা ছিল তিনশর কিছু বেশী (৮৬ জন মোহাজির, ৬১ আওস গোত্রের এবং ১৭০ জন খাযরাজ গোত্রের)।এদের মধ্যে মাত্র দুতিন জনের কাছে ঘোড়া ছিল। আর বাকি লোকদের জন্য ৭০ টির বেশী উট ছিল না। এগুলোর পিঠে তারা তিন চারজন করে পালাক্রমে সওয়ার হচ্ছিলেন। যদ্ধাস্ত্রও ছিল একেবারেই অপ্রতুল। মাত্র ৬০ জনের কাছে বর্ম ছিল। এ কারণে গুটিকয় উৎসর্গীত প্রাণ মুজাহিদ ছাড়া এ ভয়ংকর অভিযানে শরীক অধিকাংশ মুজাহিদই হৃদয়ে উৎকণ্ঠ অনুভব করেছিলেন। তারা মনে করেছিলেন , যেন তারা জেনে বুঝে মৃত্যুর মুখে এগিয়ে যাচ্ছেন। কিছু সুবিধাবাদী ধরনের লোক ইসলামের পরিসরে প্রবেশ করলেও তারা এমন ইসলামের প্রবক্তা ছিল না যাতে ধন-প্রাণের সংশয় দেখা দেয়। তারা এ অভিযানকে নিছক পাগলামী বলে অবিহিত করছিল। তারা মনে করছিল, ধর্মীয় আবেগ উচ্ছ্বাস এ লোকগুলোকে পাগলে পরিণত করেছে।কিন্তু নবী ও সাচ্চা -সত্যনিষ্ঠা মুমিনগণ একথা অনুধাবন করতে পরেছিলেন যে, এটিই প্রাণ উৎসর্গ করার সময়। তাই আল্লাহর ওপর ভরসা করে তাঁরা বের হয়ে পড়েছিলেন। তারা সোজা দক্ষিণ পশ্চিশ দিকে এগিয়ে গেলেন। এ পথেই কুরাইশদের বাহিনী মক্কা থেকে ধেয়ে আসছিল। অথচ শুরুতে যদি বাণিজ্য কাফেলা লুট করার ইচ্ছা থাকতো তাহলে উত্তর পশ্চিমের পথে এগিয়ে যাওয়া হতো।

(উল্লেখ্য বদরের যুদ্ধের ব্যাপারে ইতিহাস ও সীরাত লেখকরা যুদ্ধ কাহিনীসংক্রান্ত হাদীস ও ইতিহাস গ্রন্থগুলোয় উদ্ধৃত বর্ণনাসমূহের ওপর নির্ভর করেছেন।কিন্তু এই বর্ণনাগুলোর বিরাট অংশ কুরআন বিরোধী ও অনির্ভরযোগ্য। শুধুমাত্র ঈমানের কারণেই আমরা বদর যুদ্ধ সংক্রান্ত কুরআনী বর্ণনাকে সবচেয়ে বেশী নির্ভরযোগ্য বলে মনে করতে বাধ্য হই না বরং ঐতিহাসিক দিকে দিয়েও যদি আজ এ যুদ্ধ সংক্রান্ত সবচাইতে নির্ভরযোগ্য কোন বর্ণনা থেকে থাকে তাহলে তা হচ্ছে এ সূরা আনফাল। কারণ যুদ্ধের অব্যবহিত পরেই এটি নাযিল হয়েছিল। যুদ্ধে যারা শরীক ছিলেন এবং যুদ্ধের স্বপক্ষের বিপক্ষের সবাই এটি শুনেছিলেন ও পড়েছিলেন। নাউযুবিল্লাহ এর মধ্যে কোন একটি কথাও যদি সত্য ও বাস্তব ঘটনা বিরোধী হতো তাহলে হাজার হাজার লোক এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতো।)

রমযান মাসের ১৭তারিখে বদর নামক স্থানে উভয় পক্ষের মোকাবিলা হলো। নবী (সা) দেখলেন তিনজন কাফেরের মোকাবিলায় একজন মুসলমান দাঁড়িয়েছে এবং তাও আবার তারা পুরোপুরি অস্ত্র সজ্জিত নয়। এ অবস্থা দেখে তিনি আল্লাহর সামনে দোয়া করার জন্যে দু হাত বাড়িয়ে দিলেন। অত্যন্ত কাতর কণ্ঠে ও কান্না বিজড়িত স্বরে তিনি দোয়া করতে থাকলেনঃ

اللهم هذه قريش قد أتت بخيلائها، تحاول أن تكذب رسولك، اللهم فنصرك الذي وعدتني، اللهم أن تهلك هذه العصابة اليوم لا تعبد.

হে আল্লাহ! এই কুরাইশরা এসেছে, তাদের সকল ঔদ্বত্য ও দাম্ভিবকতা নিয়ে তোমার রসূলকে মিথ্যা প্রমাণ করতে। হে আল্লাহ! এখন তোমার সেই সাহায্য এসে যাওয়া দরকার , যার ওয়াদা তুমি করেছিলে আমার সাথে। হে আল্লাহ! যদি আজ এ মুষ্টিমেয় দলটি ধ্বংস হয়ে যায় তাহলে এ পৃথিবীতে আর কোথাও তোমার ইবাদত করার মত কেউ থাকবে না”।

এ যুদ্ধের ময়দানে মক্কার মোহাজিরদের পরীক্ষা ছিল সবচেয়ে কঠিন । তাদের আপন ভাই -চাচা ইত্যাদি তাদের বিরুদ্ধে ময়দানে সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়েছিল । কারোর বাপ, কারোর ছেলেকারোর চাচা, কারোর মামা, কারোর ভাই দাড়িয়েছিল তার প্রতিপক্ষে । এ যুদ্ধে নিজের কলিজার টুকরার ওপর তরবারী চালাতে হচ্ছিল তাদের। এ ধরনের কঠিন পরীক্ষায় একমাত্র তারাই উত্তীর্ণ হতে পারে যারা পরিপূর্ণ নিষ্ঠা এ আন্তরিকতাসহকারে হক ও সত্যের সাথে সম্পর্ক জড়েছে এবং মিথ্যা ও বাতিলের সাথে সকল প্রকার সম্পর্ক ছিন্ন করতে পুরোপুরি উদ্যোগী হয়েছে। ওদিকে আনসারদের পরীক্ষা ও কিছু কম ছিল না। এতদিন তারা মুসলমানদেরকে শুধুমাত্র আশ্রয় দিয়ে কুরাইশ ও তাদের সহযোগী গোত্রগুলোর শত্রুতার ঝুঁকি নিয়েছিল। কিন্তু এবার তো তারা ইসলামের সমর্থনে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে যাচ্ছিল। এর মানে ছিল, কয়েক হাজার লোকের একটি জনবসতি সমগ্র আরব দেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে প্রস্তুত হয়ে গেছে। এ ধরনের দুঃসাহস একমাত্র তারাই করতে পারে যারা সত্য আদর্শের ওপর ঈমান এনে তার জন্যে নিজের ব্যক্তিগত স্বার্থকে পুরোপুরি জলাঞ্জলী দিতে প্রস্তুত হতে পারে। অবশেষে তাদের অবিচল ঈমান ও সত্যানিষ্ঠা আল্লাহর সাহায্যের পুরষ্কার লাভ হয়ে গেলো। আর নিজেদের সমস্ত অহংকার ও শক্তির অহমিকা সত্ত্বেও কুরাইশরা এ সহায় সম্বলহীন জানবাজ সৈনিকদের হাতে পরাজিত হয়ে গেলো। তাদের ৭০জন নিহিত হলো, ৭০জন বন্দী হলো এবং তাদের সাজসরঞ্জামগুলো গনীমতের সামগ্রী হিসেবে মুসলমানদের দখলে এলো। কুরাইশদের যেসব বড় বড় সরদার তাদের মজলিস গুলজার করে বেড়াতো এবং ইসলাম বিরোধী আন্দোলনে যারা সর্বক্ষণ তৎপর থাকতো তারা এ যুদ্ধে নিহিত হলো। এ চুড়ান্ত বিজয় আরবে ইসলামকে একটি উল্লেখযোগ্য শক্তিতে পরিণত করলো। একজন পাশ্চত্য গবেষক লিখেছেন, বদর যুদ্ধের আগে ইসলাম ছিল শুধুমাত্র একটি ধর্ম ও রাষ্ট্র। কিন্তু বদর যুদ্ধের পরে তা রাষ্ট্রীয় ধর্মে বরং নিজেই রাষ্ট্রে পরিণত হয়ে গেলো।

সূত্রঃ তাফহীমুল কুরআন-সূরা আল আনফালের ভূমিকা থেকে।

📚📖📘📚📖📘📚📖📘📚📖📘📚📖📘📚📖📘📚📖📘📚📖📘📚📖📘📚📖📘

আমার প্রিয় বাংলা বই হোয়াইটসআপ গ্রুপে যুক্ত হতে এখানেক্লিক করুনটেলিগ্রাম গ্রুপে যুক্ত হতে এখানে ক্লিক করুন এবং ফেইসবুক গ্রুপে যুক্ত হতে এখানে ক্লিক করুন


একটি বই প্রকাশ করতে লেখক ও পাঠকের প্রচুর অর্থ খরচ হয়। জনপ্রিয় লেখকদের লেখা বই থেকে লেখক প্রকাশক সকলেই লাভবান হোন। কিন্তু যে সব লেখক জনপ্রিয় নন, তাদের বই একটি মাত্র সংস্করণে খরচই আসেনা। তাই আপনার আমার সকলের কর্তব্য হচ্ছে মূল বই খরিদ করে পড়া। এতে করে লেখক প্রকাশক উভয়েই উৎসাহিত হোন নতুন বই প্রকাশ করতে। তারা রক্ষা পান ক্ষতির হাত থেকে। এখানে প্রদত্ত বই গুলো অনলাইন থেকে সংগ্রহ করা। আপনি বইটি পড়ার পর হাতের কাছে সেই বইটি পেলেই সংগ্রহ করবেন। আপনার আপন বন্ধুজনকে উপহার দেবেন।

 

No comments:

Post a Comment

আমার প্রিয় বাংলা বই-এর যে কোন লেখাতে যে কোন ত্রুটি বা অসংগতি পরিলক্ষিত হলে দয়া করে আমাদের লিখুন।