ইসলামী আন্দোলনের সফলতাঃ মুহাম্মদ সেলিম উদ্দিন - আমার প্রিয় বাংলা বই

সাম্প্রতিকঃ

Post Top Ad

Responsive Ads Here

March 14, 2022

ইসলামী আন্দোলনের সফলতাঃ মুহাম্মদ সেলিম উদ্দিন

 


পবিত্র আল-কুরআন সর্বশক্তিমান মহান আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে তাঁর বান্দাদের জন্য “চূড়ান্ত বার্তা”। মানবজাতির মুক্তি, কল্যাণ, শান্তি ও সুপথ প্রাপ্তির জন্য সর্বশেষ পথ নির্দেশিত চিরন্তন হেদায়াতের একমাত্র মহাগ্রন্থ। এর ভাষা ও বক্তব্য শাশ্বত ও চিরঞ্জীব। বিশ্ববাসীর কাছে আল কুরআন এক জীবন্ত মুজেজা। মানব সমাজের সাফল্য কিংবা ব্যর্থতা শুধুমাত্র আল কুরআনে উল্লেখিত আদদ্বীন অর্থাৎ ‘ইসলাম’ অনুসরণ অনুকরণ কিংবা প্রত্যাখানের মধ্যেই নিহিত। এজন্য মহান আল্লাহ তায়ালা মানুষের জন্য পবিত্র আল কুরআনকে সহজ ভাষায় নাযিল করেছেন। আল্লাহ তায়ালা বলেন:
وَلَقَدْ يَسَّرْنَا الْقُرْآنَ لِلذِّكْرِ فَهَلْ مِنْ مُّدَّكِرٍ .
“আর আমরা নিশ্চয় আল কুরআনকে সহজ করেছি উপদেশ গ্রহণের জন্য, আছে কি কোনো উপদেশ গ্রহণকারী ?” (সূরা আল কামার : ১৭)
পবিত্র কুরআন নাজিল হওয়ার পর থেকে এই মহাগ্রন্থের একটি হরফও পরিবর্তন কেয়ামত পর্যন্ত হবে না। এর অনুরূপ একটি বাক্য রচনার ক্ষমতা কারো নেই এবং হবে না। নির্ভুল হেদায়াতের এই মহাগ্রন্থ হেফাজতের দায়িত্ব মহান আল্লাহ তায়ালা তাঁর নিজ দায়িত্বে রেখেছেন।
মহান আল্লাহ বলেন, “নিশ্চিতরূপেই আমিই স্মারকটি (কুরআন) প্রকাশ করেছি। আমরা এর সংরক্ষক।” (সূরা আল হিজর : ৯)
“নিশ্চয়ই এটি একটি সম্মানিত কুরআন। এটি রয়েছে সুরক্ষিত কিতাবে (উম্মুল কিতাবে)।” (সূরা আল ওয়াকে’আ : ৭৭, ৭৮)
পবিত্র কুরআনে বর্ণিত হয়েছে, “দ্বীনের ব্যাপারে কোনো জোর-জবরদস্তি নেই। প্রকৃত শুদ্ধ ও নির্ভুল কথাকে ভুল চিন্তাধারা হতে ছাঁটাই করে পৃথক করে রাখা হয়েছে।” (সূরা আল বাকারা : ২৫৬)
এ পবিত্র কিতাবের সূচনা হয়েছে একটি সুস্পষ্ট ঘোষণার মাধ্যমে, আর তা হলো : “এটি সে কিতাব যার মধ্যে কোনো সন্দেহ-সংশয়ের অবকাশ নেই। মুত্তাকীদের জন্য এটা হিদায়াত।” (সূরা আল বাকারা : ০২)
অর্থাৎ এ কিতাব থেকে হিদায়াত পেতে হলে তাকওয়ার গুণাবলি অর্জন করতে হবে। তাদের মধ্যে মন্দ থেকে বেঁচে থাকা ও ভালকে গ্রহণ করার প্রবল আগ্রহ থাকতে হবে। কুরআন মজীদ থেকে হেদায়াত লাভের জন্য এটা প্রধান ও পূর্বশর্ত।

ইসলামের পরিচয়
সিলমুন, সালমুন বা আরবী ‘সলম’ মূল ধাতু থেকে ইসলাম শব্দের উৎপত্তি। এর শাব্দিক অর্থ শান্ত হওয়া, বিশ্রামে থাকা, কর্তব্য নিস্পন্ন করা, পাওনা বা অধিকার দিয়ে দেয়া, পূর্ণ শান্তিতে থাকা, আনুগত্য করা, ‘কোন কিছু মাথা পেতে মেনে নেয়া’ ইত্যাদি। পারিভাষিক অর্থ- একমাত্র আল্লাহ প্রদত্ত ও রাসূল (সা.) প্রদর্শিত জীবন-পদ্ধতি অনুসরণ করা এবং এর বিপরীত সব স্বার্থবাদী, অলিক চিন্তা, মত-পথ ও স্বেচ্ছাচারী দৃষ্টিভঙ্গি পরিহার করে চলা। আল গাজ্জালী (রহ.) এর অর্থ লিখেছেন, আনুগত্য স্বীকার করা এবং বাধ্যতা, অস্বীকৃতি হঠকারিতা বর্জন করা।
ইসলাম হলো পরিপূর্ণ জীবন ব্যবস্থা (Complete code of life)। সেটা হলো সকল দ্বীনের সমন্বিত রূপ এবং সকল দ্বীনের সারাংশ। ইসলাম নিছক ইবাদতের জন্য নয়। ব্যক্তি, পরিবার, রাজনীতি, অর্থনীতি, আন্তর্জাতিক আইন, বিচারব্যবস্থা, সমাজ জীবন ইত্যাদি সবই ইসলামের অন্তর্ভুক্ত।
আমাদের জীবনের সর্বক্ষেত্রে ইসলামের বক্তব্য রয়েছে। আদর্শ ও জীবন বিধান হিসেবে ইসলাম ন্যায়সঙ্গত ও বাস্তবানুগ ও উন্নত যে দৃষ্টিভঙ্গি উপস্থাপন করেছে অন্য কোনো আদর্শের অবস্থান তার ধারে কাছেও নেই। মানুষের মৌলিক অধিকারের বিষয়টিও ইসলামে অত্যন্ত চমৎকারভাবে বিধৃত হয়েছে।
ইসলাম আল্লাহ তায়ালার মনোনীত একমাত্র নির্ভুল ও পূর্ণাঙ্গ ভারসাম্যপূর্ণ জীবন ব্যবস্থা। দ্বীন-ধর্ম-জীবন ব্যবস্থা হিসেবে ইসলামই মানবতার মুক্তির একমাত্র চূড়ান্ত সনদ যা হাজার হাজার বছরের ঐতিহ্যমণ্ডিত ও প্রগতিশীল। পৃথিবীতে অন্য কোন মতবাদে নির্ভুল আদর্শ এবং মহান আল্লাহ কর্তৃক মনোনীত বিধান নেই। অতএব, জীবন ব্যবস্থা হিসেবে ইসলামই একমাত্র চূড়ান্ত ব্যবস্থা।
মানুষ নিজেকে বিচার বুদ্ধিসম্পন্ন জীব বলে দাবি করে থাকে। অথচ সময়ে সময়ে সেই মানুষই এতটা যুক্তিহীন হয়ে পড়ে যে, যা কিছু সম্মানজনক, ন্যায়ানুগ সুন্দর এবং স্বাধীন তা বাদ দিয়ে স্স্পুষ্টরূপে দৃশ্যমান কুৎসিত, মিথ্যা, অপরাধমূলক এবং শয়তানি কার্যকলাপে জড়িয়ে পড়ে। এর মধ্যে কোনো পার্থক্য নির্ণয় করতে পারে না। এর কারণ এই নয় যে, মানুষের মধ্যে ভাল এবং খারাপ, সুন্দর ও অসুন্দরের মধ্যে পার্থক্য নির্ণয়ের ব্যাপারে উপযুক্ত গুণাবলি এবং জ্ঞানের অভাব রয়েছে। বরং এর কারণ এই যে, মানুষ সত্য অনুসন্ধানের উদ্দেশ্যে সামান্য পরিমাণে শ্রম প্রদানে অনিচ্ছুক। আবার যখন মানুষ সত্যের দর্শন লাভ করে, তখনো সে সেটি রক্ষার উদ্দেশ্যে তার কর্তব্য পালন করে না। বরং মানুষ তার এই আবিষ্কৃত সত্য থেকে পলায়নের চেষ্টা করে। আর সে তখন এই মর্মে অজুহাত প্রদর্শন করতে থাকে যে, আবিষ্কৃত সত্যকে গ্রহণ করলে সে পরিবার, সম্প্রদায় ও দেশবাসীর বিরাগভাজন হয়ে পড়বে।

একমাত্র ইসলাম আল্লাহর মনোনীত জীবন বিধান
পবিত্র কুরআনে এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ বলেন:
إِنَّ الدِّيْنَ عِنْدَ اللهِ الْإِسْلَامُ وَمَا اخْتَلَفَ الَّذِيْنَ أُوتُوْا الْكِتَابَ إِلَّا مِنْ بَعْدِ مَا جَاءَهُمُ الْعِلْمُ بَغْيًا بَيْنَهُمْ وَمَنْ يَكْفُرْ بِآيَاتِ اللهِ فَإِنَّ اللهَ سَرِيْعُ الْحِسَابِ .
“নি:সন্দেহে আল্লাহর নিকট একমাত্র জীবন বিধান হচ্ছে ইসলাম। যাদেরকে কিতাব দেয়া হয়েছিল, তারা এ দ্বীন থেকে সরে গিয়ে যেসব বিভিন্ন পদ্ধতি অবলম্বন করেছে, সেগুলো অবলম্বনের এ ছাড়া আর কোনো কারণই ছিল না যে, প্রকৃত জ্ঞান এসে যাওয়ার পর তারা নিজেদের মধ্যে পরস্পরের ওপর বাড়াবাড়ি করার জন্য এমনটি করেছে। আর যে কেউ আল্লাহর হিদায়াতের আনুগত্য করতে অস্বীকার করে, তার কাছ থেকে হিসাব নিতে আল্লাহর মোটেই দেরি হয় না।” (সূরা আলে ইমরান : ১৯)
মানুষের মুক্তির জন্য মহান আল্লাহ তা’য়ালা একমাত্র জীবন বিধান আল ইসলামকে মনোনীত করেছেন। সকল নবী ও রাসূল এই একটি মাত্র জীবনবিধানের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন এবং তা কায়েম করার জন্য সংগ্রাম করতে আল্লাহর পক্ষ থেকে আদিষ্ট হয়েছিলেন। (সূরা আশ-শূরা : ১৩)
অতএব মানুষের মুক্তির জন্য সিরাতুল মুস্তাকিম অর্থাৎ মানুষের প্রকৃতির সাথে সামঞ্জস্যশীল সহজ-সরল পথ একটাই যা মহান আল্লাহ তা’য়ালা আমাদের প্রতি দয়া পরবশ হয়ে নিজেই নির্ধারণ করে দিয়েছেন। যে বিষয়ের ফায়সালা আল্লাহ তা’য়ালা নিজেই চূড়ান্ত করেছেন, কৌশলের নামে সে বিষয়ের ব্যাপারে অন্য কোন কাঠামো বা পদ্ধতি কিংবা অন্য কোনো দেশ বা ব্যক্তির মডেলকে সামনে আনার অপচেষ্টা সুস্পষ্টভাবে ইসলামের সাথে সাংঘর্ষিক।
এ ব্যাপারে মহান আল্লাহ তা’য়ালার বাণী:
لَّقَدْ كَانَ لَكُمْ فِي رَسُوْلِ اللهِ أُسْوَةٌ حَسَنَةٌ .
“তোমাদের মধ্যে রাসূলুল্লাল্লাহর জীবনে রয়েছে সর্বোত্তম আদর্শ।” (সূরা আল আহযাব : ২১)
অর্থাৎ কিয়ামত পর্যন্ত বিশ্ববাসীর জন্য একমাত্র আদর্শ নেতা হচ্ছেন মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। তাঁর বিকল্প খোঁজার বা আবিষ্কারের অপচেষ্টা একটি ব্যর্থ চেষ্টা ও হীনমন্যতা ছাড়া আর কিছুই নয়। যে কোন দেশ বা জাতির কাঙ্খিত মুক্তির লক্ষ্যে যে বা যারাই যে কোন উদ্যোগ গ্রহণ করুক না কেন, প্রকৃত ও স্থায়ী সাফল্যের জন্য তাকে আল্লাহর দেয়া সিরাতুল মুস্তাকিমের পথ ও তাঁর প্রেরিত সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ নবী মুহাম্মদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে আর্দশ নেতা হিসেবে গ্রহণ ও মেনে নিয়েই তা করতে হবে। অন্যথায় দুনিয়ায় তো বটেই আখেরাতেও তাদের হতে হবে ব্যর্থ, আশাহত ও বঞ্চিত।

ইসলাম ছাড়া অন্য কোন আদর্শ গ্রহণযোগ্য হবে না
মহান আল্লাহর তা’য়ালার বাণী:
وَمَنْ يَّبْتَغِ غَيْرَ الْإِسْلَامِ دِيْنًا فَلَنْ يُّقْبَلَ مِنْهُ وَهُوَ فِى الْاٰخِرَةِ مِنَ الْخٰسِرِيْنَ ﴿٨٥۸۵﴾
“এ আনুগত্য (ইসলাম) ছাড়া যে ব্যক্তি অন্য কোন পদ্ধতি অবলম্বন করতে চায় তার সে পদ্ধতি কখনোই গ্রহণ করা হবে না এবং আখিরাতে সে হবে ব্যর্থ, আশাহত ও বঞ্চিত।” (সূরা আলে ইমরান: ৮৫)
সুতরাং নগদ পাওয়ার হাতছানিতে পড়ে কৌশলের নামে আল্লাহর বিধানের সাথে সাংঘর্ষিক কোন চিন্তা-চেতনা পোষণ করা, ইসলামকে বাদ দিয়ে নতুন কোন তথাকথিত কাঠামো, পদ্ধতি বা মডেলের নামে ইসলামের পথ থেকে সরে পড়ার বাহানা এবং প্রকৃত ঈমানদারদের মনে সন্দেহ সংশয় সৃষ্টির যেকোন অপচেষ্টা কোন মুমিনসুলভ কাজ হতে পারে না এবং এ ধরনের অপচেষ্টা ব্যর্থ হতে বাধ্য। মহান আল্লাহ বলেন:
فَلَا وَرَبِّكَ لَا يُؤْمِنُوْنَ حَتَّىٰ يُحَكِّمُوْكَ فِيْمَا شَجَرَ بَيْنَهُمْ ثُمَّ لَا يَجِدُوْا فِي أَنْفُسِهِمْ حَرَجًا مِّمَّا قَضَيْتَ وَيُسَلِّمُوْا تَسْلِيْمًا.
“কিন্তু না, হে মুহাম্মদ! তোমার রবের শপথ! এরা কখনো মুমিন হতে পারে না যতক্ষণ এদের পারস্পারিক মতবিরোধের ক্ষেত্রে এরা তোমাকে ফায়সালাকারী হিসেবে মেনে না নেবে, তারপর তুমি যা ফায়সালা করবে তার ব্যাপারে নিজেদের মনের মধ্য যে কোনো প্রকার কুণ্ঠা ও দ্বিধার স্থান দেবে না, বরং সর্বান্তকরণে মেনে নেবে।” (সূরা আন নিসা : ৬৫)
আল্লাহ তা’য়ালা এ দ্বীন বা জীবনব্যবস্থাকে একটি পূর্ণাঙ্গ দ্বীন বা জীবনব্যবস্থা হিসাবে আমাদের জন্য মনোনীত করেছেন। অর্থাৎ ইসলামের মধ্যে কোন সীমাবদ্ধতা বা দেউলিয়াত্ব নেই যে, জীবন সমস্যা সমাধানের জন্য ইসলামকে বাদ দিয়ে অন্য কোন আদর্শ বা মডেলের কাছে ছুটাছুটি করতে হবে। অন্য আদর্শের দিকে দাওয়াত দিলে সরাসরি জাহান্নামী।
পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তায়ালা বলেন:
اَلْيَوْمَ أَكْمَلْتُ لَكُمْ دِيْنَكُمْ وَأَتْمَمْتُ عَلَيْكُمْ نِعْمَتِي وَرَضِيْتُ لَكُمُ الْإِسْلَامَ دِيْنًا فَمَنِ اضْطُرَّ فِي مَخْمَصَةٍ غَيْرَ مُتَجَانِفٍ لِّإِثْمٍ فَإِنَّ اللهَ غَفُورٌ رَّحِيْمٌ.
“আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীনকে পূর্ণাঙ্গ করে দিয়েছি, আমার নিয়ামত তোমাদের প্রতি সম্পূর্ণ করেছি এবং তোমাদের জন্য ইসলামকে তোমাদের দ্বীন হিসেবে গ্রহণ করে নিয়েছি। কাজেই তোমাদের ওপর হালাল ও হারামের যে বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে তা মেনে চলো।” (সূরা আল মায়িদা : ৩)

ইসলামকে পুরোপুরি অনুসরণ করতে হবে
ইসলামের পথ ছাড়া আর যত পথ ও মত আছে সবই শয়তানের আবিষ্কার। শয়তান আমাদের মধ্যে ওয়াসওয়াসা তৈরি করে দ্বিধা-দ্বন্দ্বের মধ্যে ফেলে দিয়ে সত্য পথ থেকে সরিয়ে দিতে চায়। কাপুরুষতা, হীনমন্যতা, লোভ-লালসা ও অলীক চিন্তা-চেতনা ঢুকিয়ে দিয়ে চলার পথকে বাধাগ্রস্ত করবে এটাই শয়তানের একমাত্র কাজ। কিন্তু প্রকৃত মুমিনরা শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করতে পারে না।
সুতরাং আমাদের প্রতি আল্লাহ তা’য়ালার নির্দেশ তাঁর কাছে সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণ করতে হবে। মহান আল্লাহ বলেন:
يَا أَيُّهَا الَّذِيْنَ آمَنُوْا ادْخُلُوْا فِي السِّلْمِ كَافَّةً وَلَا تَتَّبِعُوا خُطُوَاتِ الشَّيْطَانِ إِنَّهُ لَكُمْ عَدُوٌّ مُّبِيْنٌ.
“হে ঈমানদারগণ! তোমরা পুরোপুরি ইসলামে প্রবেশ করো এবং শয়তানের অনুসারী হয়ো না, কেননা সে তোমাদের সুস্পষ্ট দুশমন।” (সূরা আল বাকারা : ২০৮)
তাছাড়া ইসলামের আংশিক অনুসরণ আল্লাহ তায়ালার কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। আংশিক ইসলাম পালনের পরিণতি সম্পর্কে মহান আল্লাহ তা’য়ালা বলেন:
أَفَتُؤْمِنُوْنَ بِبَعْضِ الْكِتَابِ وَتَكْفُرُوْنَ بِبَعْضٍ فَمَا جَزَاءُ مَنْ يَفْعَلُ ذَ‌ٰلِكَ مِنْكُمْ إِلَّا خِزْيٌ فِي الْحَيَاةِ الدُّنْيَا وَيَوْمَ الْقِيَامَةِ يُرَدُّوْنَ إِلَىٰ أَشَدِّ الْعَذَابِ وَمَا اللهُ بِغَافِلٍ عَمَّا تَعْمَلُوْنَ.
“তবে কি তোমরা কিতাবের একটি অংশের ওপর ঈমান আনছো এবং অন্য অংশের সাথে কুফরি করছো ? তারপর তোমাদের মধ্য থেকে যারাই এমনটি করবে তাদের শাস্তি এ ছাড়া আর কি হতে পারে যে, দুনিয়ার জীবনে লাঞ্ছিত ও পর্যুদস্ত হবে এবং আখিরাতে তাদেরকে কঠিনতম শাস্তির দিকে নিক্ষিপ্ত করা হবে ? তোমাদের কর্মকাণ্ড থেকে আল্লাহ তা’য়ালা বেখবর নন।” (সূরা আল বাকারা : ৮৫)
সুতরাং রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন, ভয়-ভীতি, লোভ-লালসা উপেক্ষা করে ও সর্বপ্রকার স্বেচ্ছাচারীতার নীতি পরিহার করে যারা আল্লাহর পথে দৃঢ়তার সহিত টিকে থাকবে তাদের জন্য দুনিয়া ও আখেরাতে আল্লাহর পক্ষ থেকে সাহায্য সরূপ মহা নেয়ামত এবং কিয়ামতের দিন পুরস্কার হিসেবে জান্নাতে প্রবেশ ও মহান আল্লাহর আতিথ্য লাভ করে তারা ধন্য হবে।
এ ব্যাপারে মহান আল্লাহ তা’য়ালা সূরা হামীম আস সাজদায় বলেন:
إِنَّ الَّذِيْنَ قَالُوْا رَبُّنَا اللهُ ثُمَّ اسْتَقَامُوْا تَتَنَزَّلُ عَلَيْهِمُ الْمَلَائِكَةُ أَلَّا تَخَافُوْا وَلَا تَحْزَنُوْا وَأَبْشِرُوْا بِالْجَنَّةِ الَّتِي كُنْتُمْ تُوْعَدُوْنَ.
“যারা ঘোষণা করেছে, আল্লাহ আমাদের রব, অতপর তার ওপরে দৃঢ় ও স্থির থেকেছে নিশ্চিত তাদের কাছে ফেরেশতারা আসে এবং তাদের বলে, ভীত হয়ো না, দুঃখ করো না এবং সেই জান্নাতের সুসংবাদ শুনে খুশি হও তোমাদের যার প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে।” (সূরা হামীম আস-সাজদা : ৩০)
نَحْنُ أَوْلِيَاؤُكُمْ فِي الْحَيَاةِ الدُّنْيَا وَفِي الْآخِرَةِ وَلَكُمْ فِيْهَا مَا تَشْتَهِي أَنْفُسُكُمْ وَلَكُمْ فِيْهَا مَا تَدَّعُوْنَ.
“আমরা এই দুনিয়ার জীবনেও তোমাদের বন্ধু এবং আখেরাতেও। সেখানে তোমরা যা চাবে তাই পাবে। আর যে জিনিসেরই আকাক্সক্ষা করবে তাই লাভ করবে।” (সূরা হামীম আস-সাজদা : ৩১)
نُزُلًا مِّنْ غَفُوْرٍ رَّحِيْمٍ.
“এটা সেই মহান সত্তার পক্ষ থেকে মেহমানদারীর আয়োজন যিনি ক্ষমাশীল ও দয়াবান।” (সূরা হামীম আস-সাজদা : ৩২)

ইসলামী আন্দোলন
মহান আল্লাহ প্রদত্ত দ্বীনকে বিজয়ী করার আন্দোলনের নামই ইসলামী আন্দোলন। ইসলামী আন্দোলন করা প্রত্যেক মুসলমানের ঈমানের অপরিহার্য দাবি। ইসলামী আন্দোলনের কুরআনিক পরিভাষা হচ্ছে জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহ। বর্তমানে সময়ে এ কাজ কেবল ফরজই নয়, এটা ফরজে আইন। আমৃত্যু এ কাজে সক্রিয় থাকতে হবে। রাসূল (সা.) এর ইসলামী আন্দোলনকে পাঁচটি পর্যায়ে ভাগ করা যায়। ১) দাওয়াত ইলাল্লাহ, ২) শাহাদাত আলান্নাস, ৩) কিতাল ফি সাবিলিল্লাহ, ৪) ইকামাতে দ্বীন ও ৫) আমর বিল মারুফ নেহি আনিল মুনকার। মাক্কী জীবনের তের বছর তিনি প্রথম দু’টি কাজ করেছেন এবং বাকি তিনটি কাজ মাদানী জীবনে
সম্পন্ন করেছেন।
হজরত আদম (আ.) থেকে শুরু করে হযরত মুহাম্মদ (সা.) পর্যন্ত সকল নবী-রাসূলগণই এ মহান কাজে নিয়োজিত ছিলেন। রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে দ্বীন কায়েম অনেক নবী-রাসূল করতে না পারলেও দ্বীন কায়েমের প্রচেষ্টায় সকলেই আপসহীন ছিলেন। সাহাবীগণের মাঝে এমন কোন সাহাবী খুঁজে পাওয়া যাবে না যিনি দ্বীন কায়েমের কাজ থেকে বিরত ছিলেন।
মহান আল্লাহ তায়ালা মানুষের কল্যাণের জন্য জীবন বিধান হিসেবে আল ইসলামকে মনোনীত করেছেন। এই একটি মাত্র জীবনবিধান যুগে যুগে নবী-রাসূলগণের কাছে প্রেরণ করে তা কায়েম করার জন্য নির্দেশ প্রদান করেছেন। মহান আল্লাহ বলেন:
شَرَعَ لَكُمْ مِّنَ الدِّيْنِ مَا وَصَّىٰ بِهِ نُوحًا وَالَّذِيْ أَوْحَيْنَا إِلَيْكَ وَمَا وَصَّيْنَا بِهِ إِبْرَاهِيْمَ وَمُوْسَىٰ وَعِيْسَىٰ أَنْ أَقِيْمُوْا الدِّيْنَ وَلَا تَتَفَرَّقُوْا فِيْهِ كَبُرَ عَلَى الْمُشْرِكِيْنَ مَا تَدْعُوهُمْ إِلَيْهِ اهُح يَجْتَبِي إِلَيْهِ مَنْ يَشَآءُ وَيَهْدِي إِلَيْهِ مَنْ يُنِيْبُ .
“তিনি তোমাদের জন্য দ্বীনের সেই সব নিয়ম-কানুন নির্ধারিত করেছেন যার নির্দেশ তিনি নূহকে দিয়েছিলেন এবং (হে মুহাম্মাদ) যা এখন আমি তোমার কাছে ওহির মাধ্যমে পাঠিয়েছি। আর যার আদেশ দিয়েছিলাম আমি ইবরাহীম (আ), মূসা (আ) ও ঈসাকে (আ) এই তাগিদ সহকারে যে, কায়েম করো এ দ্বীনকে এবং এ ব্যাপারে পরস্পর ছিন্ন ভিন্ন হয়ে যেয়ো না। (হে মুহাম্মাদ) এই কথাটিই এসব মুশরিকের কাছে অত্যন্ত অপছন্দনীয় যার দিকে তুমি তাদের আহ্বান জানাচ্ছো। আল্লাহ যাকে ইচ্ছা আপন করে নেন এবং তিনি তাদেরকেই নিজের কাছে আসার পথ দেখান যারা তাঁর প্রতি মনোনিবেশ করে।”(সূরা আশ-শূরা : ১৩)
সর্বশেষ নবী ও রাহমাতুল্লিল আলামিন হজরত মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে প্রেরণের উদ্দেশ্য হিসেবে মহান আল্লাহ তা’য়ালা বলেন:
هُوَ الَّذِيْ أَرْسَلَ رَسُوْلَهُ بِالْهُدى وَدِيْنِ الْحَقِّ لِيُظْهِرَهُ عَلَى الدِّيْنِ كُلِّهِ وَلَوْ كَرِهَ الْمُشْرِكُوْنَ .
“তিনিই সেই মহান সত্তা যিনি তাঁর রাসূলকে হিদায়াত এবং ‘দ্বীনে হক’ দিয়ে পাঠিয়েছেন যাতে তিনি এ দ্বীনকে অন্য সকল দ্বীনের ওপর বিজয়ী করেন, চাই তা মুশরিকদের কাছে যতই অসহনীয় হোক না কেন।’ (সূরা আস-সফ : ৯)
এছাড়া সূরা আল ফাতাহ : ২৮, সূরা আত-তাওবা : ৩৩ নং আয়াতে প্রায় একই রকম বক্তব্য রয়েছে যা দ্বারা একটি বিষয় অত্যন্ত স্পষ্ট যে, মহান আল্লাহ তা’য়ালা যুগে যুগে তাঁর বাণীবাহক নবী-রাসূলগণকে মূলত হিদায়াত ও দ্বীনকে বিজয়ী করার জন্য তাঁর পথে সংগ্রামের জন্য পাঠিয়েছিলেন এবং তাঁরা তাদের দায়িত্ব অত্যন্ত নিষ্ঠার সাথে
পালন করেছেন।
মুমিনগণের জান ও মাল আল্লাহ তা’য়ালা বেহেশতের বিনিময়ে খরিদ করে নিয়ে তাদেরকেও দ্বীন বিজয়ী করতে আল্লাহর পথে সংগ্রাম করার দায়িত্ব অর্পণ করেছেন। এ দায়িত্ব পালনের জন্য আল্লাহ তা’য়ালা মুমিদের তাঁর খলিফা ও আনসারুল্লাহর মর্যাদা প্রদান করেছেন।
মুমিনগণের দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে আল্লাহ তা’য়ালা বলেন:
إِنَّ اللهَ اشْتَرى مِنَ الْمُؤْمِنِينَ أَنْفُسَهُمْ وَأَمْوَالَهُم بِأَنَّ لَهُمُ الْجَنَّةَ يُقَاتِلُوْنَ فِي سَبِيلِ اللهِ فَيَقْتُلُونَ وَيُقْتَلُوْنَ وَعْدًا عَلَيْهِ حَقًّا فِي التَّوْرَاةِ وَالْإِنْجِيْلِ وَالْقُرْآنِ وَمَنْ أَوْفَىٰ بِعَهْدِهِ مِنَ اللهِ فَاسْتَبْشِرُوْا بِبَيْعِكُمُ الَّذِيْ بَايَعْتُم بِهِ وَذَ‌ٰلِكَ هُوَ الْفَوْزُ الْعَظِيْمُ.
“প্রকৃত ব্যাপার এই যে, আল্লাহ মুমিনদের থেকে তাদের প্রাণ ও সম্পদ জান্নাতের বিনিময়ে কিনে নিয়েছেন। তারা আল্লাহর পথে লড়াই করে এবং মারে ও মরে। তাদের প্রতি তাওরাত, ইনজিল ও কুরআনে (জান্নাতের ওয়াদা) আল্লাহর জিম্মায় একটি পাকাপোক্ত ওয়াদা বিশেষ। আর আল্লাহর চাইতে বেশি নিজের ওয়াদা পূরণকারী আর কে আছে ? কাজেই তোমরা আল্লাহর সাথে যে কেনা-বেচা করছো সে জন্য আনন্দ করো। এটিই সবচেয়ে বড় সাফল্য।” (সূরা আত তাওবা : ১১১)
মুমিনদের দায়িত্ব ও কর্তব্যের ব্যাপারে উপরোক্ত আয়াত ছাড়াও আরো বহু দৃষ্টান্ত পবিত্র আল কুরআনের পাতায় পাতায় রয়েছে। যেমন সূরা সফ : ৪, ১০, ১১, তাওবা : ১৩, ১৪, ১৫, ১৬, ১৯, ২০, ৩৮, ৩৯, ৪০, ৪১, নিসা : ৭৫, ৭৬ ইত্যাদি।
সব চাইতে বড় বিষয় হলো- ইসলামী আন্দোলন আল্লাহ তা’য়ালার নিজেরই আন্দোলন। এ আন্দোলনের মূল অভিবাবক মহান আল্লাহ তা’য়ালা। আল্লাহ, তাঁর রাসূল (সা.) ও কুরআনের আন্দোলন হিসাবে ইসলামী আন্দোলন বিজয়ী হবে এটাই স্বাভাবিক। আর এটা মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের ঘোষণাও বটে। মহান আল্লাহ তা’য়ালা বলেন:
يُرِيْدُوْنَ لِيُطْفِئُوا نُوْرَ اللهِ بِأَفْوَاهِهِمْ وَاللهُ مُتِمُّ نُوْرِهِ وَلَوْ كَرِهَ الْكَافِرُوْنَ.
“এরা তাদের মুখের ফুঁ দিয়ে আল্লাহর নূরকে নিভিয়ে দিতে চায়। অথচ আল্লাহর ফায়সালা হলো তিনি তার নূরকে পূর্ণরূপে বিকশিত করবেন। কাফেররা তা যতই অপছন্দ করুক না কেন।” (সূরা আস-সফ : ৮)
অর্থাৎ বিজয়ের পূর্ব শর্ত হলো, আমাদেরকে প্রকৃত ও খাঁটি মুমিন হতে হবে। আর ঈমান আনার শর্তই হচ্ছে তাগুতকে অস্বীকার করা। মহান আল্লাহ তা’য়ালা বলেন:
لَا إِكْرَاهَ فِي الدِّيْنِ قَد تَّبَيَّنَ الرُّشْدُ مِنَ الْغَيِّ فَمَنْ يَكْفُرْ بِالطَّاغُوتِ وَيُؤْمِن بِاللهِ فَقَدِ اسْتَمْسَكَ بِالْعُرْوَةِ الْوُثْقَىٰ لَا انفِصَامَ لَهَا وَاللهُ سَمِيْعٌ عَلِيْمٌ .
“দ্বীনের ব্যাপারে কোন জোর-জবরদস্তি নেই। ভ্রান্ত মত ও পথ থেকে সঠিক মত ও পথকে ছাঁটাই করে আলাদা করে দেয়া হয়েছে। এখন যে কেউ তাগুতকে অস্বীকার করে আল্লাহর ওপর ঈমান আনে, সে এমন একটি মজবুত অবলম্বন আঁকড়ে ধরে, যা কখনো ছিন্ন হয় না। আর আল্লাহ (যাকে সে অবলম্বন হিসেবে আঁকড়ে ধরেছে) সবকিছু শোনেন ও জানেন।” (সূরা আল বাকারা : ২৫৬)
এ আয়াতের মাধ্যমে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন পরিষ্কার করে দিয়েছেন, ঈমানের নেয়ামত কারো গলায় জোর করে পরিয়ে দেয়া হবে না। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন ভ্রান্ত মত ও পথ থেকে সঠিক মত ও পথকে স্পষ্টভাবে আলাদা করে দিয়ে সঠিক বা বেঠিক মত গ্রহণের ব্যাপারে ব্যক্তিকে স্বাধীনতা প্রদান করেছেন। চাইলে সে সত্যকে গ্রহণ করতে পারে আর না করতে চাইলেও এটা তার একান্ত বিষয়। কিন্তু কোন ব্যক্তি যদি ঈমান গ্রহণের দাবি করে তাহলে তাঁকে তাগুতকে অস্বীকার করেই তা করতে হবে। তাগুতকে অস্বীকার না করে ঈমান আনার দাবি অসার
ও হাস্যকর।
কেননা তাগুত হচ্ছে কাফিরের চাইতেও ভয়ংকর। ইসলামী চিন্তাবিদগণ তাগুতের সংজ্ঞায় বলেছেন, তাগুত নিজে তো আল্লাহর পথে চলে না অন্যকেও আল্লাহর পথে চলতে বাধা প্রদান করে। উপরোক্ত আয়াতে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন তাগুতকে সরাসরি অস্বীকার বা বর্জন করতে বলেছেন। আর কাফিরকেও বন্ধুরূপে গ্রহণ করতে নিষেধ করেছেন। এমনকি নিজের পিতা ও ভাইদেরকেও বন্ধুরূপে গ্রহণ করতে নিষেধ করেছেন যদি তারা ঈমানের পথের পরিবর্তে কুফরিকে প্রাধান্য দেয়। মহান আল্লাহ বলেন:
يَا أَيُّهَا الَّذِيْنَ آمَنُوْا لَا تَتَّخِذُوْا آبَاءَكُمْ وَإِخْوَانَكُمْ أَوْلِيَآءَ إِنِ اسْتَحَبُّوا الْكُفْرَ عَلَى الْإِيْمَانِ وَمَنْ يَتَوَلَّهُم مِّنْكُمْ فَأُولَـٰئِكَ هُمُ الظَّالِمُوْنَ.
“হে ঈমানদারগণ! তোমাদের বাপ ও ভাইয়েরা যদি ঈমানের ওপর কুফরিকে প্রাধান্য দেয় তাহলে তাদেরকেও নিজেদের বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করো না। তোমাদের মধ্যে যারা তাদেরকে বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করবে তারাই জালেম।” (সূরা আত তাওবা : ২৩) এ ব্যাপারে তাওবার ১৬নং আয়াতেও সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা রয়েছে মুমিনদের জন্য।
সুতরাং তাগুতি ও কুফরি শক্তিকে বর্জন ও বন্ধুরূপে গ্রহণ না করার ব্যাপারে মহান আল্লাহ তা’য়ালার প্রত্যাদেশ আমাদের কাছে স্পষ্ট। অথচ যে তাগুতি শক্তিটি এদেশের ইসলামী আন্দোলনের ক্ষতি করার ক্ষেত্রে সবচেয়ে অগ্রগামী, যাদের ভয়ঙ্কর চরিত্র সম্পর্কে বার বার দেশবাসীকে সজাগ ও সচেতন করেছেন মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী তাঁর অসংখ্য তাফসীর মাহফিলে। সেই নাস্তিক্যবাদীদের বুদ্ধি ও পরামর্শে এবং তাদেরকে পাশে বসিয়ে ইসলামী আন্দোলনের বিশাল প্লাটফর্মকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করার হীন কাজ থেকে মহান আল্লাহ তায়ালা সকলকে হেফাজত করুন এবং তাদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করে মহান আল্লাহর ভাষায় জালিম হওয়া থেকে রক্ষা করুন।

দুনিয়ার স্বার্থে আপসকামীতা নয়
ইসলামের পথই আসল পথ। জান্নাতে যাওয়ার সোজা রাস্তা। এ রাস্তাকে দৃঢ়তার সাথে আঁকড়ে ধরতে হবে। দুনিয়াবী স্বার্থ ও লোভ-লালসায় পড়ে এ রাস্তার ব্যাপারে কোন প্রকার সন্দেহ-সংশয় ও কম্প্রমাইজ করা যাবে না। এ ধরনের আপসকামীতার মাধ্যমে দুনিয়া ও আখিরাত দো’জাহানে সফলতা পাওয়ার কোন সুযোগ বা সম্ভাবনা নেই। সবর-আন্তরিকতা ও দৃঢ়তার সাথে ইসলামের পথে অবিচল থাকলে সফলতা আসবে বলে আল্লাহ তা’য়ালার ওয়াদা রয়েছে। সেক্ষেত্রে আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রকৃত মুমিন হওয়ার যে শর্ত দেয়া হয়েছে সেটা পূরণ করার ক্ষেত্রে আমাদের এগিয়ে আসতে হবে। তাহলেই বিজয় নিশ্চিত হতে পারে ইন-শা আল্লাহ।

ইসলামী আন্দোলন : বিজয়ের সঠিক কর্মপন্থা
মজবুত ও খাঁটি ঈমান
এ পর্যায়ে ইসলামী আন্দোলনের বিজয়ের সঠিক কর্মপন্থা নিয়ে আলোকপাত করতে চাই। ইসলামী আন্দোলনের বিজয়ের জন্য প্রধান গুণ হচ্ছে মজবুত ও খাঁটি ঈমান। বস্তুত আমরা যারা ইসলামী আন্দোলনের সফলতা চাই তাদেরকে খাঁটি মুমিনের যোগ্যতা অর্জনে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হতে হবে।
এ ব্যাপারে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন পবিত্র আল কুরআনের সূরা মুমিনুনের প্রথম ১১ আয়াতে এবং সূরা ফোরকানের শেষ রুকুতে যে বৈশিষ্ট্যগুলোর কথা বলেছেন, সেগুলো আত্মস্থ করে নিজের জীবনে বাস্তবায়ন করার পাশাপাশি ইসলামী আন্দোলনের অন্য ভাই-বোনদেরকে এ ব্যাপারে মোটিভেশন চালাতে হবে।
সূরা আল মুমিনুনে উল্লেখিত বৈশিষ্ট্যগুলো নিম্নরূপ:
قَدْ أَفْلَحَ الْمُؤْمِنُوْنَ .الَّذِيْنَ هُمْ فِي صَلَاتِهِمْ خَاشِعُوْنَ. وَالَّذِيْنَ هُمْ عَنِ اللَّغْوِ مُعْرِضُوْنَ. وَالَّذِيْنَ هُمْ لِلزَّكَاةِ فَاعِلُوْنَ. وَالَّذِيْنَ هُمْ لِفُرُوجِهِمْ حَافِظُوْنَ. إِلَّا عَلَىٰ أَزْوَاجِهِمْ أَوْ مَا مَلَكَتْ أَيْمَانُهُمْ فَإِنَّهُمْ غَيْرُ مَلُومِيْنَ. فَمَنِ ابْتَغَىٰ وَرَاءَ ذَ‌ٰلِكَ فَأُولَـٰئِكَ هُمُ الْعَادُونَ. وَالَّذِيْنَ هُمْ لِأَمَانَاتِهِمْ وَعَهْدِهِمْ رَاعُونَ. وَالَّذِيْنَ هُمْ عَلَىٰ صَلَوَاتِهِمْ يُحَافِظُوْنَ. أُولَـٰئِكَ هُمُ الْوَارِثُونَ. الَّذِيْنَ يَرِثُوْنَ الْفِرْدَوْسَ هُمْ فِيْهَا خَالِدُوْنَ. وَلَقَدْ خَلَقْنَا الْإِنْسَانَ مِنْ سُلَالَةٍ مِّنْ طِيْنٍ. ثُمَّ جَعَلْنَاهُ نُطْفَةً فِي قَرَارٍ مَّكِيْنٍ.
“নিশ্চিতভাবে সফলকাম হয়েছে মু’মিনরা যারা নিজেদের নামাজে বিনয়াবনত হয়, বাজে কাজ থেকে দূরে থাকে, জাকাতের পথে সক্রিয় থাকে, নিজেদের লজ্জাস্থানের হেফাজত করে, নিজেদের স্ত্রীদের ও অধিকারভুক্ত বাদীদের ছাড়া, এদের কাছে (হেফাজত না করলে) তারা তিরস্কৃত হবে না, তবে যারা এর বাইরে আরো কিছু চাইবে তারাই হবে সীমালঙ্ঘনকারী, নিজেদের আমানত ও প্রতিশ্রুতি রক্ষা করে, এবং নিজেদের নামাযগুলো রক্ষণাবেক্ষণ করে। তারাই এমন ধরনের উত্তরাধিকারী যারা নিজেদের উত্তরাধিকার হিসেবে ফিরদাউস লাভ করবে এবং সেখানে তারা চিরকাল বসবাস করবে।”
এ ব্যাপারে মহান আল্লাহ তা’য়ালা সূরা আল ফোরকানের ৬৩ থেকে ৭৬ নাম্বার আয়াতে যা বলেন:
وَعِبَادُ الرَّحْمَـٰنِ الَّذِيْنَ يَمْشُوْنَ عَلَى الْأَرْضِ هَوْنًا وَإِذَا خَاطَبَهُمُ الْجَاهِلُونَ قَالُوا سَلَامًا .
৬৩) রহমানের (আসল) বান্দা তারাই যারা পৃথিবীর বুকে নম্রভাবে চলাফেরা করে এবং মূর্খরা তাদের সাথে কথা বলতে থাকলে বলে দেয়,
وَالَّذِيْنَ يَبِيْتُوْنَ لِرَبِّهِمْ سُجَّدًا وَقِيَامًا .
৬৪) তোমাদের সালাম। তারা নিজেদের রবের সামনে সিজদায় অবনত হয়ে ও দাঁড়িয়ে রাত কাটিয়ে দেয়।
وَالَّذِيْنَ يَقُوْلُوْنَ رَبَّنَا اصْرِفْ عَنَّا عَذَابَ جَهَنَّمَ إِنَّ عَذَابَهَا كَانَ غَرَامًا .
৬৫) তারা দোয়া করতে থাকে: “হে আমাদের রব ! জাহান্নামের আযাব থেকে আমাদের বাঁচাও, তার আযাব তো সর্বনাশা।
إِنَّهَا سَاءَتْ مُسْتَقَرًّا وَمُقَامًا .
৬৬) আশ্রয়স্থল ও আবাস হিসেবে তা বড়ই নিকৃষ্ট জায়গা।
وَالَّذِيْنَ إِذَا أَنْفَقُوْا لَمْ يُسْرِفُوا وَلَمْ يَقْتُرُوا وَكَانَ بَيْنَ ذَ‌ٰلِكَ قَوَامًا .
৬৭) তারা যখন ব্যয় করে তখন অযথা ব্যয় করে না এবং কার্পণ্যও করে না বরং উভয় প্রান্তিকের মাঝামাঝি তাদের ব্যয় ভারসাম্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত থাকে।
وَالَّذِيْنَ لَا يَدْعُوْنَ مَعَ اللهِ إِلَـٰهًا آخَرَ وَلَا يَقْتُلُوْنَ النَّفْسَ الَّتِي حَرَّمَ اللهُ إِلَّا بِالْحَقِّ وَلَا يَزْنُوْنَ وَمَنْ يَفْعَلْ ذَ‌ٰلِكَ يَلْقَ أَثَامًا .
৬৮) তারা আল্লাহ ছাড়া আর কোন উপাস্যকে ডাকে না, আল্লাহ যে প্রাণ হারাম করেছেন কোন সংগত কারণ ছাড়া তাকে হত্যা করে না এবং ব্যভিচার করে না এসব যে-ই করে সে তার গোনাহের শাস্তি ভোগ করবে।
يُضَاعَفْ لَهُ الْعَذَابُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ وَيَخْلُدْ فِيْهِ مُهَانًا .
৬৯) কিয়ামতের দিন তাকে উপর্যুপরি শাস্তি দেয়া হবে এবং সেখানেই সে পড়ে থাকবে চিরকাল লাঞ্ছিত অবস্থায়।
إِلَّا مَنْ تَابَ وَآمَنَ وَعَمِلَ عَمَلًا صَالِحًا فَأُولَـٰئِكَ يُبَدِّلُ اللهُ سَيِّئَاتِهِمْ حَسَنَاتٍ وَكَانَ اللهُ غَفُورًا رَّحِيْمًا.
৭০) তবে তারা ছাড়া যারা (ঐসব গুনাহের পর) তাওবা করেছে এবং ঈমান এনে সৎ কাজ করতে থেকেছে। এ ধরনের লোকদের অসৎ কাজগুলোকে আল্লাহ সৎকাজের দ্বারা পরিবর্তন করে দেবেন এবং আল্লাহ বড়ই ক্ষমাশীল ও মেহেরবান।
وَمَنْ تَابَ وَعَمِلَ صَالِحًا فَإِنَّهُ يَتُوبُ إِلَى اللهِ مَتَابًا .
৭১) যে ব্যক্তি তাওবা করে সৎকাজের পথ অবলম্বন করে, সে তো আল্লাহর দিকে ফিরে আসার মতই ফিরে আসলো।
وَالَّذِيْنَ لَا يَشْهَدُوْنَ الزُّورَ وَإِذَا مَرُّوا بِاللَّغْوِ مَرُّوا كِرَامًا .
৭২) (আর রহমানের বান্দা হচ্ছে তারা) যারা মিথ্যা সাক্ষ্য দেয় না এবং কোন বাজে জিনিসের কাছ দিয়ে পথ অতিক্রম করতে থাকলে ভদ্রলোকের মত অতিক্রম করে যায়।
وَالَّذِيْنَ إِذَا ذُكِّرُوا بِآيَاتِ رَبِّهِمْ لَمْ يَخِرُّوا عَلَيْهَا صُمًّا وَعُمْيَانًا .
৭৩) তাদের যদি তাদের রবের আয়াত শুনিয়ে উপদেশ দেয়া হয় তাহলে তারা তার প্রতি অন্ধ বধির হয়ে থাকে না।
وَالَّذِيْنَ يَقُوْلُوْنَ رَبَّنَا هَبْ لَنَا مِنْ أَزْوَاجِنَا وَذُرِّيَّاتِنَا قُرَّةَ أَعْيُنٍ وَاجْعَلْنَا لِلْمُتَّقِيْنَ إِمَامًا .
৭৪) তারা প্রার্থনা করে থাকে, “হে আমাদের রব! আমাদের নিজেদের স্ত্রীদের ও নিজেদের সন্তানদেরকে নয়ন শীতলকারী বানাও এবং আমাদের করে দাও মুত্তাকীদের ইমাম।”
أُولَـٰئِكَ يُجْزَوْنَ الْغُرْفَةَ بِمَا صَبَرُوا وَيُلَقَّوْنَ فِيْهَا تَحِيَّةً وَسَلَامًا.
৭৫) এরাই নিজেদের সবরের ফল উন্নত মনজিলের আকারে পাবে। অভিবাদন ও সালাম সহকারে তাদের সেখানে অভ্যর্থনা করা হবে।
خَالِدِيْنَ فِيهَا حَسُنَتْ مُسْتَقَرًّا وَمُقَامًا .
৭৬) তারা সেখানে থাকবে চিরকাল। কতই না উত্তম সেই আশ্রয় এবং সেই আবাস! এছাড়াও কুরআন-হাদীসের বিভিন্ন জায়গায় মুমিনের গুণাবলি সংক্রান্ত যেসব আয়াত ও সহীহ হাদীস রয়েছে, সেগুলো আত্মস্থ করে আমাদের জীবনে বাস্তবায়নের পাশাপাশি ইসলামী বিপ্লব বা দ্বীনকে বিজয়ের প্রকৃত পন্থা ভালোভাবে জেনে নিতে হবে।

ব্যাপক দাওয়াতি কাজ করতে হবে
ইসলামী বিপ্লবের সফলতার জন্য যে বৈশিষ্ট্য ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদের অবশ্যই অর্জন করতে হবে তা হলো- ব্যাপক দাওয়াতি কাজ। মহান আল্লাহ তায়ালা এটাকে শেষ নবীর প্রধান কাজ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। মহান আল্লাহ বলেন:
قُلْ هَـٰذِهِ سَبِيْلِي أَدْعُو إِلَى اللهِ عَلَىٰ بَصِيْرَةٍ أَنَا وَمَنِ اتَّبَعَنِيْ وَسُبْحَانَ اللهِ وَمَا أَنَا مِنَ الْمُشْرِكِيْنَ .
অর্থ ঃ “হে নবী, তাদের বলোঃ আমি এবং আমার অনুসারীরা মানুষকে সজ্ঞানে আল্লাহর দিকে দাওয়াত দেই এটাই আমার পথ।” (সূরা ইউসুফ : ১০৮)
وَلْتَكُن مِّنْكُمْ أُمَّةٌ يَدْعُوْنَ إِلَى الْخَيْرِ وَيَأْمُرُوْنَ بِالْمَعْرُوْفِ وَيَنْهَوْنَ عَنِ الْمُنكَرِ وَأُولَـٰئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُوْنَ .
অর্থ ঃ “তোমাদের মধ্যে অবশ্য এমন একদল লোক থাকতে হবে যারা কল্যাণের দিকে আহ্বান করবে, ন্যায় কাজের নির্দেশ দেবে এবং অন্যায় কাজে বাধা দেবে।” (সূরা আলে ইমরান : ১০৪)
وَمَنْ أَحْسَنُ قَوْلًا مِّمَّن دَعَا إِلَى اللهِ وَعَمِلَ صَالِحًا وَقَالَ إِنَّنِي مِنَ الْمُسْلِمِيْنَ .
অর্থ ঃ “ঐ ব্যক্তির চাইতে উত্তম কথা আর কার হতে পারে, যে আল্লাহর দিকে দাওয়াত দেয় এবং নিজে নেক আমল করে আর বলে, আমি একজন মুসলিম।” (সূরা হামীম আস-সাজদা : ৩৩)
বিদায় হজ্জের সময় মুহাম্মদ (সা.) তাঁর উম্মতের ওপর এই দায়িত্ব অর্পণ করে যান। অর্থঃ “তোমরা যারা আমার কাছে উপস্থিত, তারা অনুপস্থিত লোকদের কাছে আমার পক্ষ থেকে এ আহ্বান অবশ্যই পৌঁছে দেবে।” (মুসনাদে আহমাদ)
দাওয়াতি কাজকে ফলপ্রসূ করার লক্ষ্যে সকল শ্রেণি পেশার মানুষের সাথে ব্যাপক সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপন করতে হবে। এ লক্ষ্যে গণসংযোগ করতে হবে। প্রতিবেশী ও আত্মীয়-স্বজনের হক আদায় করতে হবে। প্রতিবেশী পরিবারগুলোর সাথে দাওয়াত ও কল্যাণের উদ্দেশ্যে সেবামূলক তৎপরতা চালানো দরকার।
মৌখিক দাওয়াতের পাশাপাশি চারিত্রিক মাধুর্যতার মাধ্যমে ইসলামের বাস্তব সাক্ষ্য তাদের সামনে উপস্থাপন করতে হবে। এ ব্যাপারে জামায়াত প্রতিষ্ঠাতা সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী (রহ.) তাঁর লিখিত ‘ইসলামী আন্দোলন : সাফল্যের শর্তাবলী’ বইয়ে কর্মীদের চরিত্র ও মাধুর্য সম্পর্কে বলেছেন, “খোদার পথে যারা কাজ করবেন তাদের উদার হৃদয় ও বিপুল হিম্মতের অধিকারী, সৃষ্টির প্রতি সহানুভূতিশীল ও মানবতার দরদী, ভদ্র ও কোমল স্বভাবসম্পন্ন, আত্ননির্ভরশীল ও কষ্ট সহিষ্ণু, মিষ্টভাষী ও সদালাপি হতে হবে। তাদের দ্বারা কারো কোন ক্ষতি হবে এমন কোনো ধারণাও যেন কেউ পোষণ করতে না পারে। তাদের থেকে কল্যাণ ও উপকার সবাই কামনা করবে। নিজের প্রাপ্যের চাইতে কমের ওপর সন্তুষ্ট ও অন্যকে প্রাপ্যের চাইতে বেশি দিতে প্রস্তুত থাকবে। মন্দের জবাব ভালো দিয়ে দিবে। কমপক্ষে মন্দ দিয়ে দিবে না।”
“নিজের দোষত্রুটি স্বীকার ও অন্যের গুণাবলির কদর করবে। অন্যের দুর্বলতার প্রতি নজর না দেয়ার মতো বিরাট হৃদয়পটের অধিকারী হবে। অন্যের দোষত্রুটি ও বাড়াবাড়ি মাফ করে দেবে। নিজের জন্য কারো ওপর প্রতিশোধ নেবে না। অন্যের সেবা গ্রহণ করে নয়, অন্যকে সেবা দিয়ে আনন্দিত হবে। নিজের স্বার্থে নয়, অন্যের ভালোর জন্য কাজ করবে। কোন প্রকার প্রশংসার অপেক্ষা কিংবা নিন্দাবাদের তোয়াক্কা না করে নিজের দায়িত্ব পালন করে যাবে। খোদা ছাড়া কারো পুরস্কারের প্রতি দৃষ্টি দেবে না।”
“বল প্রয়োগ করে তাদের দমন করা যাবে না, ধন-সম্পদের বিনিময়ে ক্রয় করা যাবে না। কিন্তু সত্য ও ন্যায়ের সামনে নির্দ্বিধায় ঝুঁকে পড়বে। তাদের শত্রুরাও তাদের ওপরে বিশ্বাস রাখবে যে, কোন অবস্থায়ই তারা ভদ্রতা ও ন্যায়নীতি বিরোধী কোন কাজ করবে না। এগুলো তলোয়ারের চাইতেও ধারালো এবং হীরা, মনি-মুক্তার চেয়েও মূল্যবান। এ চারিত্রিক গুণাবলি মানুষের মন জয় করে নেয়। এ ধরনের গুণাবলি অর্জনকারীরা চারপাশের জনবসতির ওপর বিজয় লাভ করে।”

মৌলিক মানবীয় গুণাবলী অর্জন
এছাড়াও মাওলানা মওদূদীর (রহ.) মতে এ বিজয়ের জন্য ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদের নিম্নোক্ত মৌলিক মানবীয় গুণাবলির অধিকারী
হতে হবে:
“ইচ্ছা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ শক্তি, প্রবল বাসনা, উচ্ছাসা ও নির্ভীক সাহস, সহিষ্ণুতা ও দৃঢ়তা, ত্যাগ-তিতিক্ষা, সহনশীলতা ও পরিশ্রমপ্রিয়তা, উদ্দেশ্যের প্রতি প্রবল আকর্ষণ এবং সেজন্য সব কিছুরই উৎসর্গ করার প্রবণতা, সতর্কতা, দূরদৃষ্টি ও অন্তরদৃষ্টি, বোধশক্তি ও বিচার ক্ষমতা, পরিস্থিতি যাচাই করা ও তদানুযায়ী নিজেকে ঢেলে গঠন করা, অনুকূল কর্মনীতি গ্রহণ করার যোগ্যতা, নিজের হৃদয়াবেগ, ইচ্ছা-বাসনা, স্বপ্নসাধ ও উত্তেজনার সংযমশক্তি, অন্য মানুষকে আকৃষ্ট করা ও তাদেরকে কাজে লাগানোর বিচক্ষণতা কারো মধ্যে পুরোপুরি বর্তমান থাকলে তবে এ দুনিয়ায় তার জয় সুনিশ্চিত।”

প্রয়োজন একটি সুসংগঠিত আন্দোলন
মানবজাতিকে বর্তমান শোচনীয় ও বেদনাদায়ক পরিণতি থেকে বাঁচাবার জন্য তাই আজ প্রয়োজন একটি নিষ্ঠাবান ও সৎ মানব গোষ্ঠীর এগিয়ে আসা। একটি শক্তিশালী ও সুসংগঠিত আন্দোলন গড়ে তোলা। যার মাধ্যমে সকল প্রকার জালিম-জুলুম তৃণখণ্ডের ন্যায় ভেসে যাবে। মহান আল্লাহ বলেন:
“তোমরা ততক্ষণ পর্যন্ত সংগ্রাম অব্যাহত রাখ যতক্ষণ না ফিতনা নির্মূল হয়ে দ্বীন একমাত্র আল্লাহর জন্য নির্ধারিত হয়ে যায়।” (সূরা আনফাল : ৩৯)
সে লক্ষ্যকে বাস্তবায়নের জন্য ১৯৪১ সালের ২৬ আগস্ট মাত্র ৭৫ জন লোক ৭৫ টাকা ৭৫ আনা তহবিল নিয়ে এ উপমহাদেশে জামায়াতে ইসলামী নামে সংগঠনটি যাত্রা শুরু করে। যা হাঁটি হাঁটি পা পা করে আজ এক বিশাল মহিরুহে পরিণত হয়েছে।
এছাড়া প্রয়োজন এমন একটি কর্মী বাহিনীর যাদের আদর্শের ওপর সাচ্চা ঈমান ও অবিচল আস্থা রয়েছে। তাদের সবার আগে প্রমাণ করে দেখাতে হবে তাদের ঈমান কতখানি মজবুত।

ঈমানের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া
ইসলামী আন্দোলনের সফলতার জন্য আরেকটি মৌলিক বিষয় হচ্ছে- ঈমানের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া। এটা আল্লাহ তা’য়ালার আরেকটি বড় কৌশল। এ পরীক্ষার মাধ্যমে তিনি সত্য-সঠিক পথ এবং মজবুত ঈমানদারদের মিথ্যা, বাতিল, কৃত্রিম, মেকি, মুনাফিক ও ভেজাল থেকে আলাদা করার ব্যবস্থা গ্রহণ করেছেন। যা সত্য পথের পথিক ঈমানদার মুজাহিদদের জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে এক বিশাল উপহার। এর মাধ্যমে দুর্বলচিত্ত, ভীতু, কাপুরুষ ও কপট ব্যক্তিরা শতই বাছাই ও ছাঁটাই
হয়ে যায়।
এ ব্যাপারে মহান আল্লাহ তা’য়ালা বলেন:
أَحَسِبَ النَّاسُ أَن يُتْرَكُوْا أَن يَقُولُوا آمَنَّا وَهُمْ لَا يُفْتَنُوْنَ . وَلَقَدْ فَتَنَّا الَّذِيْنَ مِنْ قَبْلِهِمْ فَلَيَعْلَمَنَّ اللهُ الَّذِيْنَ صَدَقُوْا وَلَيَعْلَمَنَّ الْكَاذِبِيْنَ .
“লোকেরা কি মনে করে রেখেছে, “আমরা ঈমান এনেছি” কেবলমাত্র একথাটুকু বললেই তাদেরকে ছেড়ে দেয়া হবে, আর পরীক্ষা করা হবে
না ? অথচ আমি তাদের পূর্ববর্তীদের সবাইকে পরীক্ষা করে নিয়েছি। আল্লাহ অবশ্যই দেখবেন কে সত্যবাদী এবং কে মিথ্যুক।” (সূরা আল আনকাবুত : ২-৩)
أَمْ حَسِبْتُمْ أَن تَدْخُلُوا الْجَنَّةَ وَلَمَّا يَأْتِكُم مَّثَلُ الَّذِيْنَ خَلَوْا مِنْ قَبْلِكُمْ مَّسَّتْهُمُ الْبَأْسَاءُ وَالضَّرَّاءُ وَزُلْزِلُوْا حَتَّىٰ يَقُوْلَ الرَّسُوْلُ وَالَّذِيْنَ آمَنُوا مَعَهُ مَتَىٰ نَصْرُ اللهِ أَلَا إِنَّ نَصْرَ اللهِ قَرِيْبٌ .
“তোমরা কি মনে করেছো, এমনিতেই তোমরা জান্নাতে প্রবেশ করে
যাবে ? অথচ তোমাদের আগে যারা ঈমান এনেছিল তাদের ওপর যা কিছু নেমে এসেছিল এখনও তোমাদের ওপর সেসব নেমে আসেনি। তাদের ওপর নেমে এসেছিল কষ্ট-ক্লেশ ও বিপদ-মুসিবত, তাদেরকে প্রকম্পিত করা হয়েছিল। এমনকি সমকালীন রাসূল এবং তাঁর সাথে যারা ঈমান এনেছিল তারা চিৎকার করে বলে উঠেছিল, আল্লাহর সাহায্য কবে
আসবে ? তখন তাদেরকে সান্তনা দিয়ে বলা হয়েছিলো, অবশ্যই আল্লাহর সাহায্য অতি নিকটে।” (সূরা আল বাকারা : ২১৪)
وَلَنَبْلُوَنَّكُم بِشَيْءٍ مِّنَ الْخَوْفِ وَالْجُوعِ وَنَقْصٍ مِّنَ الْأَمْوَالِ وَالْأَنْفُسِ وَالثَّمَرَاتِ وَبَشِّرِ الصَّابِرِيْنَ . الَّذِيْنَ إِذَا أَصَابَتْهُم مُّصِيْبَةٌ قَالُوا إِنَّا لِلّهِ وَإِنَّا إِلَيْهِ رَاجِعُوْنَ. أُولَـٰئِكَ عَلَيْهِمْ صَلَوَاتٌ مِّنْ رَّبِّهِمْ وَرَحْمَةٌ وَأُولَـٰئِكَ هُمُ الْمُهْتَدُوْنَ.
“আর নিশ্চয়ই আমরা ভীতি, অনাহার, প্রাণ ও সম্পদের ক্ষতির মাধ্যমে এবং উপার্জন ও আমদানী হ্রাস করে তোমাদের পরীক্ষা করবো। এ অবস্থায় যারা সবর করে, তাদেরকে সুসংবাদ দাও এবং যখনই কোনো বিপদ আসে যারা বলে, আমরা আল্লাহর জন্যে এবং আল্লাহর দিকে আমাদের ফিরে যেতে হবে। তাদের রবের পক্ষ থেকে তাদের ওপর বিপুল অনুগ্রহ বর্ষিত হবে, তাঁর রহমত তাদের ছায়াদান করবে এবং এই ধরনের লোকেরাই সঠিকপথগামী।” (সূরা আল বাকারা : ১৫৫-১৫৭)
أَمْ حَسِبْتُمْ أَن تُتْرَكُوا وَلَمَّا يَعْلَمِ اللهُ الَّذِيْنَ جَاهَدُوْا مِنْكُمْ وَلَمْ يَتَّخِذُوْا مِنْ دُوْنِ اللهِ وَلَا رَسُوْلِهِ وَلَا الْمُؤْمِنِيْنَ وَلِيجَةً وَاللهُ خَبِيْرٌ بِمَا تَعْمَلُوْنَ .
“তোমরা কি মনে করছো যে, তোমাদের এতোটুকুতেই ছেড়ে দেয়া হবে, অথচ আল্লাহ এখন পর্যন্ত বাস্তবে জেনে নেননি তোমাদের মধ্য থেকে কারা (তাঁর পথে) সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালালো এবং আল্লাহর রাসূল ও মুমিনদের ছাড়া অন্য কাউকেও অন্তরঙ্গ বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করলো না ? আল্লাহ ভালোভাবেই জানেন তোমরা যা আমল করো।” (সূরা তাওবা : ১৬)
أَمْ حَسِبْتُمْ أَن تَدْخُلُوا الْجَنَّةَ وَلَمَّا يَعْلَمِ اللهُ الَّذِينَ جَاهَدُوْا مِنْكُمْ وَيَعْلَمَ الصَّابِرِيْنَ .
“তোমরা কি মনে করে রেখেছো তোমরা এমনিতেই জান্নাতে প্রবেশ করবে ? অথচ এখনো আল্লাহ দেখেনইনি, তোমাদের মধ্যে কে তাঁর পথে প্রাণপণ যুদ্ধ করতে প্রস্তুত এবং কে তাঁর জন্য সবরকারী।” (সূরা আলে ইমরান : ১৪২)
وَلَنَبْلُوَنَّكُمْ حَتَّىٰ نَعْلَمَ الْمُجَاهِدِيْنَ مِنْكُمْ وَالصَّابِرِيْنَ وَنَبْلُوَ أَخْبَارَكُمْ .
“আমি তোমাদেরকে অবশ্যই পরীক্ষা করবো যাতে আমি তোমাদের অবস্থা যাচাই করে দেখে নিতে পারি তোমাদের মধ্যে কে জিহাদকারী এবং কে ধৈর্যশীল।” (সূরা মুহাম্মদ : ৩১)
এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ তা’য়ালা তাঁর প্রিয় হাবিব মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে উদ্দেশ্য করে বলেন:
قَدْ نَعْلَمُ إِنَّهُ لَيَحْزُنُكَ الَّذِيْ يَقُوْلُوْنَ فَإِنَّهُمْ لَا يُكَذِّبُوْنَكَ وَلَـٰكِنَّ الظَّالِمِيْنَ بِآيَاتِ اللهِ يَجْحَدُوْنَ . وَلَقَدْ كُذِّبَتْ رُسُلٌ مِّنْ قَبْلِكَ فَصَبَرُوْا عَلَىٰ مَا كُذِّبُوْا وَأُوْذُوْا حَتَّىٰ أَتَاهُمْ نَصْرُنَا وَلَا مُبَدِّلَ لِكَلِمَاتِ اللهِ وَلَقَدْ جَاءَكَ مِنْ نَّبَإِ الْمُرْسَلِينَ . وَإِن كَانَ كَبُرَ عَلَيْكَ إِعْرَاضُهُمْ فَإِنِ اسْتَطَعْتَ أَنْ تَبْتَغِيَ نَفَقًا فِي الْأَرْضِ أَوْ سُلَّمًا فِي السَّمَاءِ فَتَأْتِيَهُم بِآيَةٍ وَلَوْ شَاءَ اللهُ لَجَمَعَهُمْ عَلَى الْهُدَىٰ فَلَا تَكُونَنَّ مِنَ الْجَاهِلِينَ.
“হে মুহাম্মাদ ! একথা অবশ্য জানি, এরা যেসব কথা তৈরি করে, তা তোমাকে কষ্ট দেয় কিন্তু এরা তোমাকে মিথ্যা বলে না বরং এ জালেমরা আসলে আল্লাহর আয়াতকেই অস্বীকার করছে।”
“তোমাদের পূর্বেও অনেক রসূলকে মিথ্যা বলা হয়েছে কিন্তু তাদের ওপর যে মিথ্যা আরোপ করা হয়েছে এবং যে কষ্ট দেয়া হয়েছে, তাতে তারা সবর করেছে। শেষ পর্যন্ত তাদের কাছে আমার সাহায্য পৌঁছে গেছে। আল্লাহর কথাগুলো পরিবর্তন করার ক্ষমতা কারোর নেই এবং আগের রাসূলদের সাথে যা কিছু ঘটে গেছে তার খবর তো তোমার কাছে পৌঁছে গেছে।”
“তবুও যদি তাদের উপেক্ষা তোমার কাছে অসহনীয় হয়ে থাকে তাহলে তোমার মধ্যে কিছু শক্তি থাকলে তুমি ভূগর্ভে কোন সুরঙ্গ খুঁজে নাও অথবা আকাশে সিড়িঁ লাগাও এবং তাদের কাছে কোন নিদর্শন আনার চেষ্টা করো। আল্লাহ চাইলে এদের সবাইকে হিদায়াতের ওপর একত্র করতে পারতেন। কাজেই মূর্খদের অন্তর্ভুক্ত হয়ো না।” (সূরা আল আনআম : ৩৩-৩৫)
সুতরাং যেখানে মহান আল্লাহ তা’য়ালা বলেন, ‘আমি অবশ্যই অবশ্যই তোমাদেরকে কিছু বিষয়ে পরীক্ষা করবো।’সেখানে ইসলামী আন্দোলনের এ পথে পরীক্ষা আসাটাই স্বাভাবিক। না আসাটা বরঞ্চ অস্বাভাবিক।
এ ধরনের পরীক্ষা নেয়ার ৩টি বড় কারণের কথা মহান আল্লাহ পবিত্র আল কুরআনে উল্লেখ করেছেন :
১। খাঁটি ও মেকী বাছাই করা :
তোমরা যে অবস্থায় রয়েছ মুমিনদেরকে সেই অবস্থায় থাকতে দেয়া আল্লাহর রীতি নয় (অর্থাৎ মুমিন ও মুনাফিক মিলেমিশে থাকা) খাঁটি ও মেকী বাছাই না করে আল্লাহ ক্ষান্ত হবেন না।” (সূরা আলে ইমরান : ১৭৯)
এ ব্যাপারে মাওলানা মওদূদী (রাহি.) তাঁর বিভিন্ন লেখনিতে উল্লেখ করেছেন “বস্তুত সত্য এক অতি সুক্ষদর্শী ও দক্ষ স্বর্ণকার। সে বিন্দুমাত্র ভেজালও গ্রহণ করতে রাজি হয় না। সে চায় একেবারে নির্ভেজাল খাঁটি সোনা। কঠিন অগ্নী পরীক্ষার মধ্য দিয়ে সমস্ত মেকী পুড়ে গিয়ে খাঁটি সোনা বেরিয়ে না আসা পর্যন্ত সে তাকে বাজারে ছাড়তে দিতে ও তার নামে চালু হতে দিতে প্রস্তুন হয় না। মেকীর দায়িত্ব সে নিতে নারাজ, কেননা সে সত্য। সে বাতিলের ন্যায় জাল মুদ্রা বা ভেজাল সোনা বাজারে ফেরী করে বেড়াতে পারে না।”
২। আল্লাহর রীতি হল এক দলকে দিয়ে অন্য দলকে পরীক্ষা করা : “আল্লাহ যদি চাইতেন তবে নিজেই তাদের পর্যুদস্ত করে দিতেন। তবে তোমাদের এক দলকে দিয়ে অন্য দলকে পরীক্ষা করাই আল্লাহর রীতি।” (সূরা মুহাম্মদ : ৪)
এ ব্যাপারে মহান আল্লাহ মুমিনদের লক্ষ্য করে সূরা তাওবার ১৪ নং আয়াতে বলেন, “তোমরা যুদ্ধ করো তাদের বিরুদ্ধে, তিনি তোমাদের হাতেই তাদেরকে শাস্তি দিবেন এবং তাদেরকে লাঞ্ছিত করবেন ও তাদের বিরুদ্ধে তোমাদেরকে বিজয়ী করবেন আর মুমিনদের অন্তরকে করবেন প্রশান্ত, আর তিনি দূর করে দেবেন তোমাদের মনের ক্ষোভ।
৩। পরীক্ষার মাধ্যমেই হিদায়াত, মুত্তাকি হওয়ার সার্টিফিকেট এবং প্রভুর পক্ষ থেকে অনুগ্রহ ও করুণা এবং তাঁর মাগফিরাত, সন্তুষ্টি ও জান্নাত লাভের নিশ্চয়তা লাভ করা যায়। (সূরা বাকারা : ১৫৫, ১৭৭, তাওবা : ২০ ও ১১১)

বস্তুত ইসলামী আন্দোলন ও অন্য দশটি সাধারণ আন্দোলনের বিজয়ের পথ ও পন্থা এক নয়। সাধারণ আন্দোলনের বিজয়ের ক্ষেত্রে নগদ পাওয়ার হাতছানি তাড়িয়ে বেড়ায়। তারা সাময়িক বিজয়ের জন্য উন্মুখ হয়ে থাকে। যেন-তেনভাবে ক্ষমতায় যেতে পারলেই খুশি। ভোটের আগের রাতে জনগণের রায় কেড়ে নিয়ে হলেও তাতে কোন অসুবিধা নেই।
সাধারণ আন্দোলনের মুখ্য লক্ষ্যই থাকে ক্ষমতায় আরোহণ করা। কিন্তু ইসলামী আন্দোলন তার সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম। ইসলামী আন্দোলন ভোটের আগের রাতে নয়, বরঞ্চ ভোটের এক সপ্তাহ আগেই কিংবা ভোট গ্রহণের সারাদিনই নিজেদের প্রভাবাধীন এলাকায় এক চেটিয়া জালভোট দেয়ার সুযোগ পেলেও জনগণের রায় কেড়ে নিয়ে নোংরা পথে ক্ষমতায় যাওয়াকে কখনই বৈধ মনে করে না। এ ধরনের অবৈধ সুযোগ গ্রহণ করে ক্ষমতায় যাওয়ার কোন চিন্তাই করতে পারে না।
কিন্তু কিছু লোকের হাব-ভাব, কথাবার্তা, আচরণ ও ফেসবুকের স্ট্যাটাসে মনে হয় ইসলামী আন্দোলন নামক এ মহান আন্দোলনও যেন-তেন ভাবে ক্ষমতায় যাওয়ার তথাকথিত কৌশল গ্রহণ করুক। দুনিয়ার কোথাও কেউ কোনভাবে ক্ষমতায় চলে এলে এবং কিছুদিন টিকে গেলে এটাকেই তারা মহা সাফল্য বলে শোরগোল করছে।
অথচ তাড়াতাড়ি ও যেন-তেন ভাবে ক্ষমতায় যাওয়া ইসলামী আন্দোলনের সাফল্যের মানদণ্ড নয়। ইসলামী আন্দোলন এক সর্বব্যাপী সাফল্যের নাম। প্রকৃত অর্থে মহান আল্লাহর মাগফিরাত লাভ করে জান্নাত লাভ করাই হচ্ছে প্রকৃত সফলতা। (সূরা সফ : ১০, ১১, তাওবা : ২০, ১১১)
আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্ধারিত পরীক্ষার ব্যাপারে নানা কথা
ইসলামী আন্দোলনকে নানা প্রতিবন্দকতা অতিক্রম করেই সামনে এগুতে হয়। মহান আল্লাহ তা’য়ালা কর্তৃক নির্ধারিত এ পরীক্ষা পদ্ধতিকে সঠিকভাবে উপলব্ধি করতে না পারার কারণে নানা প্রশ্ন উত্থাপিত হয়।
কেউ-কেউ আন্দোলনের বিগত সময়ের বিভিন্ন সিদ্ধান্ত ও কার্যক্রম নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। তারা বলে ইসলামী আন্দোলনের সাফল্যের জন্য এত কুরবানির কি দরকার ছিলো ? অথবা এগুলো হয়েছে কোন রাজনৈতিক ভুল সিদ্ধান্তের কারণে।
এ ধরনের বক্তব্য শুধু তারাই দিতে পারে যাদের কাছে কুরআনি দৃষ্টিভঙ্গি পরিষ্কার নয়। কিংবা পরিষ্কার থাকলেও সত্য ও ন্যায়ের জন্য ত্যাগ স্বীকারে অনীহা এমনকি সামান্য পরিমাণে শ্রম প্রদানেও অনিচ্ছুক। সত্যের যে নেয়ামত লাভে তারা ধন্য হয়েছিল তা রক্ষায় নিজের কর্তব্য পালনে গাফিল। পলায়নপর মানসিকতার কারণে এ পথে সার্বিকভাবে দায়িত্ব পালন করতে তারা বিশেষ সম্প্রদায়ের ও দেশবাসীর বিরাগভাজন ও জুলুম-নির্যাতনের স্টিমরোলারকে ভয় পায়।
কোনো বিশেষ সালকে সামনে এনে যারা এ ধরনের প্রশ্ন উত্থাপন করেন তাদের যদি পাল্টা প্রশ্ন করা হয় ১৯৭০ সালে পল্টনে জামায়াতে ইসলামীর জনসভায় হামলা করে যে ২ জন ভাইকে শহীদ করা হলো, সে ব্যাপারে আপনার বক্তব্য কি ? কারণ তখন তো ’৭১ সাল ছিল না। তারও আগে জামায়াত ইসলামীর প্রথম দিকে লাহোর সম্মেলনে সরকারি গুণ্ডাবাহিনী সশস্ত্র হামলা চালিয়ে একজনকে শহীদ করাসহ আন্দোলনের অসংখ্য কর্মীদের আহত করেছিলো। সে ব্যাপারে বক্তব্য কি ? তখনও তো
’৭১ আসেনি।
মিশর ও তুরস্কে ইসলামী আন্দোলনের নেতা-কর্মীগণ তাদের স্ব-স্ব দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠা ও রক্ষার আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন বলে আমরা জানি। কিন্তু তাদের ওপর জুলুম-নির্যাতনের কারণ কী ? এ ধরনের কথাবার্তা বলে মূলত ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদের মাঝে সংশয় সৃষ্টির চেষ্টা করা হয়।
ইসলাম ও ইসলামী আন্দোলনের বিরোধীরা প্রকৃত অর্থে আল্লাহ বিরোধী
যারা জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহ বা ইসলামী আন্দোলনের বিরোধিতা করে তারা মূলত আল্লাহরই বিরোধিতা করে। তাদের ব্যাপারে ফায়সালার ভার আল্লাহর হাতেই রয়েছে। (আন-আম : ৩৩-৩৫) প্রকৃত ইসলামী আন্দোলনের কর্মীরা এসব বিরোধিতা-নির্যাতন দেখে ঘাবড়ে যায় না।
এদিক ওদিক ছুটাছুটি এবং পালিয়ে বেড়ায় না। বরং তারা নির্যাতনের সম্মুখীন হয়ে খাঁটি সোনায় পরিণত হয়। ইসলামী আন্দোলন ও ইসলামী আন্দোলনের নেতৃত্বকে আরো বেশি ভালোবাসতে, এমনকি নিজের জীবনের চাইতেও ভালোবাসতে শেখে। সব ধরনের নগদ পাওয়ার হাতছানি ভয়ভীতি ও লোভ-লালসার উর্ধ্বে উঠে দ্বীনকে বিজয়ী করার জন্য তারা আরো দৃঢ়তার সাথে নিরলসভাবে কাজ করে যায়।
আর যারা দুর্বলচেতা ও নেফাক্বের রোগে আক্রান্ত তারা এসব পরীক্ষাকে আল্লাহর আজাব মনে করে। এর থেকে নিরাপদ দূরে থাকার চেষ্টা করে। ইসলামী আন্দোলন ও ইসলামী নেতৃত্ব এমনকি ইসলামী আন্দোলনের শহীদ নেতৃবৃন্দের ব্যাপারেও কুৎসা রটনা করতে তারা লজ্জাবোধ করে না। তাদের পরিচয় সম্পর্কে মহান আল্লাহ তা’য়ালা পবিত্র কুরআনে বলেন:
وَمِنَ النَّاسِ مَن يَقُولُ آمَنَّا بِاللهِ فَإِذَا أُوذِيَ فِي اللهِ جَعَلَ فِتْنَةَ النَّاسِ كَعَذَابِ اللهِ وَلَئِن جَاءَ نَصْرٌ مِّن رَّبِّكَ لَيَقُولُنَّ إِنَّا كُنَّا مَعَكُمْ ۚ أَوَلَيْسَ اللهُ بِأَعْلَمَ بِمَا فِي صُدُورِ الْعَالَمِينَ. وَلَيَعْلَمَنَّ اللهُ الَّذِينَ آمَنُوا وَلَيَعْلَمَنَّ الْمُنَافِقِينَ .
“লোকদের মধ্যে এমন কেউ আছে যে বলে, আমরা ঈমান এনেছি আল্লাহর প্রতি। কিন্তু যখন সে আল্লাহর ব্যাপারে নিগৃহীত হয়েছে তখন লোকদের চাপিয়ে দেয়া পরীক্ষাকে আল্লাহর আযাবের মতো মনে করে নিয়েছে। এখন যদি তোমার রবের পক্ষ থেকে বিজয় ও সাহায্য এসে যায়, তাহলে এ ব্যক্তিই বলবে, “আমরা তো তোমাদের সাথে ছিলাম”। বিশ্ববাসীদের মনের অবস্থা কি আল্লাহ ভালোভাবে জানেন না ? আর আল্লাহ তো অবশ্যই দেখবেন কারা ঈমান এনেছে এবং কারা মুনাফিক। (সূরা আল আনকাবুত : ১০-১১)
মুনাফিকদের পরিচয় সম্পর্কে পবিত্র আল কুরআনের সূরা বাকারার কয়েকটি আয়াত উল্লেখযোগ্য:
وَمِنَ النَّاسِ مَنْ يَقُوْلُ آمَنَّا بِاللهِ وَبِالْيَوْمِ الْآخِرِ وَمَا هُمْ بِمُؤْمِنِيْنَ.
৮) কিছু লোক এমনও আছে যারা বলে, আমরা আল্লাহর ওপর ও আখেরাতের দিনের ওপর ঈমান এনেছি, অথচ আসলে তারা মু’মিন নয়।
يُخَادِعُوْنَ اللهَ وَالَّذِيْنَ آمَنُوْا وَمَا يَخْدَعُوْنَ إِلَّا أَنْفُسَهُمْ وَمَا يَشْعُرُوْنَ.
৯) তারা আল্লাহর সাথে ও যারা ঈমান এনেছে তাদের সাথে ধোঁকাবাজি করেছে। কিন্তু আসলে তারা নিজেদেরকেই প্রতারণা করছে, তবে তারা এ ব্যাপারে সচেতন নয়।
فِي قُلُوبِهِمْ مَّرَضٌ فَزَادَهُمُ اللَّهُ مَرَضًا ۖ وَلَهُمْ عَذَابٌ أَلِيْمٌ بِمَا كَانُوْا يَكْذِبُوْنَ .
১০) তাদের হৃদয়ে আছে একটি রোগ, আল্লাহ সে রোগ আরো বাড়িয়ে দিয়েছেন, আর যে মিথ্যা তারা বলে তার বিনিময়ে তাদের জন্য রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি।
وَإِذَا قِيْلَ لَهُمْ لَا تُفْسِدُوْا فِي الْأَرْضِ قَالُوا إِنَّمَا نَحْنُ مُصْلِحُوْنَ .
১১) যখনই তাদের বলা হয়েছে, জমিনে ফাসাদ সৃষ্টি করো না, তারা একথাই বলেছে, আমরা তো সংশোধনকারী।
أَلَا إِنَّهُمْ هُمُ الْمُفْسِدُوْنَ وَلَـٰكِن لَّا يَشْعُرُوْنَ .
১২) সাবধান! এরাই ফাসাদ সৃষ্টিকারী, তবে তারা এ ব্যাপারে সচেতন নয়।
وَإِذَا قِيْلَ لَهُمْ آمِنُوْا كَمَا آمَنَ النَّاسُ قَالُوْا أَنُؤْمِنُ كَمَا آمَنَ السُّفَهَاءُ ۗ أَلَا إِنَّهُمْ هُمُ السُّفَهَاءُ وَلَـٰكِن لَّا يَعْلَمُوْنَ .
১৩) আর যখন তাদের বলা হয়েছে, অন্য লোকেরা যেভাবে ঈমান এনেছে তোমরাও সেভাবে ঈমান আনো তখন তারা এ জবাবই দিয়েছেÑ আমরা কি ঈমান আনবো নির্বোধদের মতো ? সাবধান! আসলে এরাই নির্বোধ, কিন্তু এরা জানে না।
وَإِذَا لَقُوا الَّذِيْنَ آمَنُوْا قَالُوْا آمَنَّا وَإِذَا خَلَوْا إِلَىٰ شَيَاطِيْنِهِمْ قَالُوْا إِنَّا مَعَكُمْ إِنَّمَا نَحْنُ مُسْتَهْزِئُوْنَ .
১৪) যখন এরা মু’মিনদের সাথে মিলিত হয়, বলে: “আমরা ঈমান এনেছি,” আবার যখন নিরিবিলিতে নিজেদের শয়তানদের সাথে মিলিত হয় তখন বলে: “আমরা তো আসলে তোমাদের সাথেই আছি আর ওদের সাথে তো নিছক তামাশা করছি।” (সূরা আল বাকারা : ৮-১৪)
মুনাফিকের বৈশিষ্ট্য সম্বলিত ওপরের আয়াতগুলো পাঠ করলেই প্রকৃত মুমিনের হৃদয় আঁতকে ওঠার কথা। আজকে আমাদের প্রত্যেকের বিবেককে প্রশ্ন করতে হবে। আমরা তো সকলেই নিজেদেরকে মুমিন দাবি করে আসছি। কিন্তু আমরা কি আল্লাহর দেয়া ফরমান অনুযায়ী তাগুতকে বাস্তবে অস্বীকার করতে পেরেছি ? আমরা কি ঈমানের পরিবর্তে কুফরীর পথকে যারা প্রাধান্য দেয় তাদেরকে বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করা থেকে বিরত থাকতে পেরেছি ? আমরা কি আল্লাহর রাস্তায় সংগ্রামের পথে জুলুম-নির্যাতনকে সহজভাবে মেনে নিতে পেরেছি ? আমরা কি সব ধরনের ফিতনা-ফাসাদ সৃষ্টি থেকে বিরত থাকতে পারছি?
যদি পেরে থাকি তাহলে নিঃসন্দেহে আমরা সাচ্চা মুমিন। মহান আল্লাহ তা’য়ালা আমাদের ঈমানের শক্তিকে আরো বাড়িয়ে দিন, আমীন। কিন্তু কারো মাঝে যদি উপরোক্ত মুনাফিকী বৈশিষ্ট্যের বিন্দু বিসর্গ থেকে থাকে, আন্তরিকভাবে আত্মপর্যালোচনা করে তা থেকে বেরিয়ে এসে খাঁটি মুমিন হওয়ার প্রচেষ্টা জোরদার করতে হবে। কারণ মুনাফিকের শাস্তি সম্পর্কে মহান আল্লাহ তা’য়ালা বলেন, “মুনাফিকের অবস্থান হবে জাহান্নামের সর্বনিম্নস্তরে।”
মহান আল্লাহ তা’য়ালা লেখকসহ সকল মুমিন-মুমিনাকে ‘আদনা নেফাক’ থেকে হেফাজত করুন এবং আমাদের সকলের জন্য জান্নাতের ফায়সালা করুন।
ইসলামী আন্দোলনের সাফল্যের জন্য আরো দরকার: আন্তরিকতা, সবর ও ইস্তেকামাত। সবর ও সালাত সম্পর্কে মহান আল্লাহ তা’য়ালা বলেন:
يَا أَيُّهَا الَّذِيْنَ آمَنُوْا اسْتَعِيْنُوْا بِالصَّبْرِ وَالصَّلَاةِ إِنَّ اللهَ مَعَ الصَّابِرِيْنَ .
“হে ঈমানদারগণ! সবর ও নামাযের দ্বারা সাহায্য গ্রহণ করো, আল্লাহ সবরকারীদের সাথে আছেন।” (সূরা আল বাকারা : ১৫৩)
মাওলানা মওদূদী (রহ.) সবরের কয়েকটি অর্থ করেছেন। তাড়াহুড়া না করা, নিজের প্রচেষ্টার ত্বরিত ফল লাভের জন্য অস্থির না হওয়া এবং বিলম্ব দেখে হিম্মত হারিয়ে না বসা। যা বর্তমানে কিছু কিছু লোকের মধ্যে পরিলক্ষিত হচ্ছে। এটা মোটেই কাম্য নয়। ধৈর্যশীল ব্যক্তি সারাজীবন একটি উদ্দেশ্য সম্পাদনের জন্য অনবরত পরিশ্রম করতে থাকে এবং একের পর এক ব্যর্থতার সম্মুখীন হয়েও পরিশ্রম থেকে বিরত হয় না।
সবরের আরেকটি অর্থ হলো- তিক্ত স্বভাব, দুর্বল মত ও সংকল্পহীনতার রোগে আক্রান্ত না হওয়া। বাধা বিপত্তির বিরোচিত মোকাবেলা করা। এছাড়া সকল প্রকার ভয়ভীতি ও লোভ লালসার মোকাবেলায় সঠিক পথে অবিচল থাকা। দুনিয়ার স্বার্থ উদ্ধারের পথ প্রশস্ত দেখে এবং সাফল্যের সুযোগ সুবিধা নিজের হাতের মধ্যে পেয়েও পূর্ণ মানসিক নিশ্চিন্ততার সাথে একমাত্র নিজের লক্ষ্য অর্জনের পথে লব্ধ দানের ওপর সন্তুষ্ট থাকার
নাম ধৈর্য।
আলহামদুলিল্লাহ, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী সহ ছাত্র-ছাত্রী, শ্রমিক আন্দোলনের নেতা-কর্মীরা সকল ভয়ভীতি ও লোভ-লালসার ঊর্ধ্বে উঠে বাধা বিপত্তির বিরচিত মোকাবেলা করে বাংলাদেশে ইসলামী আন্দোলনের স্বাভাবিক অগ্রযাত্রাকে অব্যহত রাখতে পেরেছে। জামায়াতে ইসলামী যে একটি সত্য আন্দোলন এটাই হচ্ছে বড় প্রমাণ এবং এটি রীতিমত মিরাকলও বটে।
দুনিয়ার সাধারণ আন্দোলনের রঙিন চশমায় ইসলামী আন্দোলনকে দেখতে যারা অভ্যস্ত তারা ইসলামী আন্দোলনের ১০০টি ত্রুটি বের করতে পারবেন। কারণ তারা ইসলামী আন্দোলনের বিজয়ের ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গি ও মানদণ্ড থেকে অনেক দূরে অবস্থান করছেন। সাধারণ আন্দোলনের সফলতার জন্য যা লাগে ইসলামী আন্দোলন বিজয়ের জন্য তার সবকিছুর দরকার হয় না। আর ইসলামী আন্দোলনের বিজয়ের জন্য যা দরকার হয়, সাধারণ আন্দোলনের কর্মীদের মধ্যে তার ছিটেফোঁটাও সাধারণত থাকে না।
সাধারণ আন্দোলনের বিজয়ের জন্য প্রয়োজন হয় অর্থ, বিত্ত-বৈভব, জনবল, অস্ত্রবল, রণকৌশল ইত্যাদি। ইসলামী আন্দোলনের বিজয়ের জন্য প্রয়োজন ঈমান, চরিত্রবল, সবর, আন্তরিকতা, আদর্শের ওপর অটল-অবিচল থাকা ও আদর্শকে জীবনের উদ্দেশ্য হিসেবে গ্রহণ করে আল্লাহর পথে সবকিছুর উৎসর্গ করার প্রবণতা, প্রয়োজনে নিজের জীবন উৎসর্গ করে শাহাদাতের অমিয় সূধা পান করা ইত্যাদি। সর্বোপরি আল্লাহর সাহায্যের মাধ্যমে চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত হয় এবং মুমিনদের ব্যাপারে আল্লাহর পক্ষ থেকে এই সাহায্যের ওয়াদা রয়েছে। মহান আল্লাহ তা’য়ালা বলেন, “মুমিনদেরকে সাহায্য করা আমার হক”।
বইঃ আল-কুরআনের আলোকে ইসলামী আন্দোলনের সফলতা
পৃষ্ঠাঃ ২৯-৩৪
বিগত সময়ে মহান আল্লার সাহায্যের বাস্তব নমুনা আমরা দেখতে পেয়েছি। তা না হলে দেশি-বিদেশি ইসলাম বিরোধী শক্তির যে ভয়াবহ হামলা ইসলামী আন্দোলনের ওপর পরিচালিত হয়েছে তাতে এ আন্দোলন টিকে থাকার কথা নয়। কিন্তু মহান আল্লাহ ইসলামী আন্দোলনের নেতা-কর্মীদের টিকে থাকার শক্তি যুগিয়েছেন। ইনশাআল্লাহ, এই আন্দোলন টিকে থাকবে এবং তার কাক্সিক্ষত মঞ্জিলে অতি দ্রুততার সাথে এগিয়ে যাবে। তবে সেজন্য প্রয়োজন একটি সর্বব্যাপী নিয়মতান্ত্রিক সুশৃঙ্খল ও শক্তিশালী আন্দোলন গড়ে তোলা।
বাংলাদেশের অধিকারহারা শোষিত বঞ্চিত মানুষের সব ধরনের ন্যায্য অধিকার আদায়ের সংগ্রামে এই আন্দোলন নেতৃত্ব দেবে, ইন-শা আল্লাহ। এই আন্দোলন যতটুকু অগ্রগতি লাভ করেছে তা সম্ভব হয়েছে মহান আল্লাহর দেয়া তাওফিক মোতাবেক আন্দোলনের ময়দানে সঠিক ভূমিকা রাখতে পারা এবং আন্দোলনের নেতা-কর্মীদের ত্যাগ-কুরবানি, সবর ও আন্তরিকতার ফলে। সেজন্য লক্ষ্য পানে সুদৃঢ়ভাবে অটল অবিচল থেকে কাক্সিক্ষত মুক্তির লক্ষ্যে এগিয়ে যেতে হবে।
মহান আল্লাহ তা’য়ালা পবিত্র কুরআনে বলেন:
إِنَّ الَّذِيْنَ قَالُوْا رَبُّنَا اللهُ ثُمَّ اسْتَقَامُوا تَتَنَزَّلُ عَلَيْهِمُ الْمَلَائِكَةُ أَلَّا تَخَافُوْا وَلَا تَحْزَنُوْا وَأَبْشِرُوْا بِالْجَنَّةِ الَّتِي كُنْتُمْ تُوعَدُوْنَ.
যারা ঘোষণা করেছে, আল্লাহ আমাদের রব, অতপর তার ওপরে দৃঢ় ও স্থির থেকেছে, নিশ্চিত তাদের কাছে ফেরেশতারা আসে এবং তাদের বলে, ভীত হয়ো না, দুঃখ করো না এবং সেই জান্নাতের সুসংবাদ শুনে খুশি হও তোমাদেরকে যার প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে।
نَحْنُ أَوْلِيَاؤُكُمْ فِي الْحَيَاةِ الدُّنْيَا وَفِي الْآخِرَةِ ۖ وَلَكُمْ فِيْهَا مَا تَشْتَهِي أَنْفُسُكُمْ وَلَكُمْ فِيْهَا مَا تَدَّعُوْنَ .
আমরা এই দুনিয়ার জীবনেও তোমাদের বন্ধু এবং আখেরাতেও। সেখানে তোমরা যা চাবে তাই পাবে। আর যে জিনিসেরই আকাঙ্খা করবে তাই লাভ করবে।
نُزُلًا مِّنْ غَفُوْرٍ رَّحِيْمٍ .
এটা সেই মহান সত্তার পক্ষ থেকে মেহমানদারীর আয়োজন যিনি ক্ষমাশীল ও দয়াবান। (সূরা হামীম আস-সাজদাহ : ৩০-৩২)
সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে দীন প্রতিষ্ঠার কাজ আল্লাহ তা’য়ালার নিজের দায়িত্ব। তিনি মানুষ ছাড়া অন্য সকল সৃষ্টির জন্য তাঁর বিধান স্বয়ংক্রিয়ভাবে কায়েম করেছেন। মানব শরীরেও তাঁর বিধান তিনি নিজেই প্রতিষ্ঠা করেছেন। কিন্তু মানুষের সামাজিক জীবনের বিধান প্রতিষ্ঠার জন্য মানুষকে তাঁর খলিফা ও আনসারুল্লাহর মর্যাদায় অভিষিক্ত করেছেন।
মুমিনের দায়িত্ব হলো খলিফা ও আনসারুল্লাহ হিসেবে তাদের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করা। এ ব্যাপারে মহান আল্লাহ তা’য়ালা বলেন:
وَجَاهِدُوا فِي اللهِ حَقَّ جِهَادِهِ هُوَ اجْتَبَاكُمْ وَمَا جَعَلَ عَلَيْكُمْ فِي الدِّينِ مِنْ حَرَجٍ مِّلَّةَ أَبِيكُمْ إِبْرَاهِيمَ هُوَ سَمَّاكُمُ الْمُسْلِمِينَ مِن قَبْلُ وَفِي هَـٰذَا لِيَكُونَ الرَّسُولُ شَهِيدًا عَلَيْكُمْ وَتَكُونُوا شُهَدَاءَ عَلَى النَّاسِ فَأَقِيمُوا الصَّلَاةَ وَآتُوا الزَّكَاةَ وَاعْتَصِمُوا بِاللهِ هُوَ مَوْلَاكُمْ فَنِعْمَ الْمَوْلَىٰ وَنِعْمَ النَّصِيرُ .
“এবং জিহাদ কর আল্লাহর পথে যেমন জিহাদ করলে তার হক আদায় হয়। তিনি নিজের কাজের জন্য তোমাদের বাছাই করে নিয়েছেন এবং দ্বীনের ব্যাপারে তোমাদের ওপর কোনো কঠোরতা আরোপ করেননি। তোমরা তোমাদের পিতা ইবরাহীমের মিল্লাতের ওপর প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাও। আল্লাহ আগেও তোমাদের নাম রেখেছিলেন ‘মুসলিম’ এবং এর (কুরআন) মধ্যেও (তোমাদের নাম এটিই) যাতে রাসূল তোমাদের ওপর সাক্ষী হন এবং তোমরা সাক্ষী হও লোকদের ওপর। কাজেই নামাজ কায়েম করো, জাকাত দাও এবং আল্লাহর সাথে সম্পৃক্ত হয়ে যাও; তিনিই তোমাদের অভিভাবক, বড়ই ভালো অভিভাবক তিনি, বড়ই উত্তম সাহায্যকারী তিনি।” (সূরা আল হজ : ৭৮)
মহান আল্লাহ তা’য়ালা বলেন:
قُلْ إِن كَانَ آبَاؤُكُمْ وَأَبْنَاؤُكُمْ وَإِخْوَانُكُمْ وَأَزْوَاجُكُمْ وَعَشِيرَتُكُمْ وَأَمْوَالٌ اقْتَرَفْتُمُوهَا وَتِجَارَةٌ تَخْشَوْنَ كَسَادَهَا وَمَسَاكِنُ تَرْضَوْنَهَا أَحَبَّ إِلَيْكُم مِّنَ اللهِ وَرَسُولِهِ وَجِهَادٍ فِي سَبِيلِهِ فَتَرَبَّصُوا حَتَّىٰ يَأْتِيَ اللهُ بِأَمْرِهِ وَاللهُ لَا يَهْدِي الْقَوْمَ الْفَاسِقِينَ .
হে নবী! বলে দাও, যদি তোমাদের পিতা, তোমাদের সন্তান ও তোমাদের ভাই তোমাদের স্ত্রী, তোমাদের আত্মীয়-স্বজন, তোমাদের উপার্জিত সম্পদ, তোমাদের যে ব্যবসায়ে মন্দা দেখা দেয়ার ভয়ে তোমরা তটস্থ থাক এবং তোমাদের যে বাসস্থানকে তোমরা খুবই পছন্দ করÑএসব যদি আল্লাহ ও তার রাসূল এবং তার পথে জিহাদ করার চাইতে তোমাদের কাছে বেশি প্রিয় হয়, তাহলে আল্লাহর ফায়সালা তোমাদের কাছে না আসা পর্যন্ত অপেক্ষা কর। আর আল্লাহ ফাসেকদের কখনো সত্য পথের সন্ধান দেন না। (সূরা আত তাওবা : ২৪)
আমাদের দায়িত্ব হলো, এ পথে এগিয়ে যাওয়া। যারা এগিয়ে যাবে তারা অবশ্যই আল্লাহর সাহায্য লাভ করবে। আর যারা আল্লাহর সাহায্য পাবে তারা অবশ্যই সফলকাম হবে। তবে সফলতা কখন আসবে তা আল্লাহ তা’য়ালাই নির্ধারণ করবেন। আমাদের দায়িত্ব হলো চেষ্টা করে যাওয়া। মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (সা.) কেও আল্লাহ তা’য়ালা বলেছেন, “হে নবী! আপনার কাজ হলো পৌছে দেয়া।” অন্যত্র বলেছেন, “আপনাকে দারোগা করে পাঠানো হয়নি।” আরেক জায়গায় বলেছেন, “হে নবী আপনি চাইলেই হবে না, রাব্বুল আলামিনের ইচ্ছা লাগবে।”
দ্বীন কখন কোথায় প্রতিষ্ঠিত বা বিজয়ী হবে এটা একান্তই রাব্বুল আলামিনের বিষয়। বিজয় কিংবা ক্ষমতায় যেতে দেরি হচ্ছে এ জাতীয় কথা বলে হই-চই করা নিতান্তই ইসলামী জ্ঞানের দৈন্যতা ছাড়া আর কিছুই নয়। মহান আল্লাহ তা’য়ালা কুরআনে সাফল্যের কথা যত জায়গায় বলেছেন তার সব জায়গায় একই রকম বক্তব্য এসেছে। আর তা হলো- “তোমাদের গুনাহ মাফ করে দেয়া হবে এবং এমন জান্নাতে প্রবেশ করানো হবে যার নিচ দিয়ে ঝর্ণাধারা প্রবাহিত।”
তাই তো আল্লাহ রাব্বুল আলামিন মুমিনদের তাঁর মাগফিরাত ও জান্নাত লাভের জন্য প্রতিযোগিতার মাধ্যমে দৌড়াতে বলেছেন। ইসলামী আন্দোলনের প্রকৃত সফলতা হচ্ছে, আল্লাহর মাগফিরাত লাভ এবং তাঁর সন্তুষ্টি অর্জন করে জান্নাত লাভ করা। আর দুনিয়াতে খেলাফত প্রতিষ্ঠা এবং ইসলামী আন্দোলনকে বিজয় দান এটা একান্তভাবে আল্লাহ তা’য়ালার ইচ্ছাধীন। দুনিয়াতে কোনো এলাকায় যদি সেরকম কোন অবস্থা বিরাজ করে যেখানে দ্বীন প্রতিষ্ঠার উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি হয়ে গেছে, তাহলে মহান আল্লাহ তা’য়ালা তাঁর অনুমোদন ও সাহায্যের মাধ্যমে কোন দল বা জাতিকে সেখানে দ্বীন প্রতিষ্ঠার সুযোগ দেবেন এবং তারা সফলও হবেন ইনশাআল্লাহ।
বইঃ আল-কুরআনের আলোকে ইসলামী আন্দোলনের সফলতা
পৃষ্ঠাঃ ৩৫-৩৮

No comments:

Post a Comment

আমার প্রিয় বাংলা বই-এর যে কোন লেখাতে যে কোন ত্রুটি বা অসংগতি পরিলক্ষিত হলে দয়া করে আমাদের লিখুন।